চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

মাছ-মাংস পাতে উঠছে না নিম্ন আয়ের মানুষের

শ্রম খাতে দুই তৃতীয়াংশ মজুরি ১০ হাজার টাকার কম

আরাফাত বিন হাসান

২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ

মা, বোন, স্ত্রী আর দুই কন্যা নিয়ে কর্ণফুলীর তীরবর্তী কালারপোল এলাকায় থাকেন ২৮ বছর বয়সী মো. নাজের। চার বছর আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ এই তরুণ। এই চার বছরে মোট তিন হাজার টাকা বেড়েছে নাজেরের বেতন।

 

চার বছরে বেতন তিন হাজার টাকা বাড়লেও ক্রয় ক্ষমতা কমেছে তার। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে সংসারের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। উচ্চ মূল্যের কারণে সুস্থ জীবন ধারণের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ আমিষ জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হচ্ছে তাকে।

 

 

পূর্বকোণকে নাজের বলেন, ‘গরুর মাংস বা মুরগি কোনো দাওয়াতে গেলে কিংবা বাসায় কোনো মেহমান আসলে খাওয়া হয়। বাকী সময় এড়িয়ে চলি। যে হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সে হারে উপার্জন বাড়ছে না। কাজেরও অভাব, তাই বাধ্য হয়ে কম বেতনেও চাকরি করতে হচ্ছে।’

 

অনেকটা একই কথা বলেন নগরীর বহদ্দারহাট এলাকার গৃহিণী তাইরিন জুয়েল। তিনি জানান, তার স্বামী ১৪ হাজার টাকা বেতন পান, গেল ৫ বছরে কখনোই বেতন বাড়েনি তার। বাসাভাড়াসহ অন্যান্য ব্যয় মিটিয়ে মাসে সর্বোচ্চ একবার মাছ বা ব্রয়লার মুরগি কিনতে পারেন। তবে সম্প্রতি সেই চাকরিটাও হারিয়েছেন তাইরিনের স্বামী। তাই ধার-দেনা করে কোনোভাবে ডাল-সবজি দিয়েই খাবার সারছে তার পরিবার।

 

শুধু নাজের কিংবা তাইরিন নন, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চড়া দামের চাপে খাদ্য তালিকা থেকে আমিষ তথা মাছ-মাংস-ডিম বাদ দিচ্ছেন অনেকেই। পাতে টান পড়ছে মধ্যবিত্তের।

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গেল তিন বছরে রীতিমতো লাফিয়ে বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতি। ২০২১ সালের পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ গড় মুদ্রাস্ফীতি পরের বছর দুই দশমিক দুই শতাংশ বেড়ে দাড়ায় সাত দশমিক সাত শতাংশে। ২০২৩ সালে আরও এক দশমিক আট শতাংশ বেড়ে নয় দশমিক পাঁচ শতাংশে দাড়ায় গড় মুদ্রাস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতির ক্রমাগত উর্ধ্বগতির প্রভাব পড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে। গেল আগস্টেই দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

 

টিসিবির বাজার দর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঠিক পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে গতকাল ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোটা চাল, সয়াবিন তেল, আলু, ডাল, ডিম, ব্রয়লার মুরগি ও রুই মাছের দাম গড়ে অর্ধেকের বেশি (৫৪ দশমিক ৭২ শতাংশ) বেড়েছে। এরমধ্যে মোটা চালের ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ, সয়াবিন তেলের ৫১ দশমিক ৮১ শতাংশ, আলুর ১২০ শতাংশ, ডালের ৮৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ডিমের (হালি) ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগির ২৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং রুই মাছের দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে।

 

এদিকে নিম্ন মজুরি বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ৪১টি শ্রম খাতের শ্রমিকদের মাসিক মজুরি ৫২১ টাকা থেকে ১৭ হাজার ৯০০ টাকা পর্যন্ত। তবে এর প্রায় দুই তৃতীয়াংশ খাতের শ্রমিকদের মজুরি তিন থেকে চার অংকের। অর্থাৎ ১০ হাজার টাকার কম।
অন্যদিকে, দেশে গেল কয়েক বছরে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির চাপে দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকেই। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উধ্বগতি অন্যদিকে অপর্যাপ্ত মজুরি-এই দুয়ের আকাশ-পাতাল ফারাকে নাভিশ্বাস  নিম্নআয়ের মানুষের।

 

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘মানুষ আর পেরে উঠছে না, অনেকেই এতদিন ধারদেনা করে হলেও স্বাভাবিক উপায়ে চলার চেষ্টা করেছে, এখন আর পারছে না। তাই অনেকে খাদ্য তালিকা থেকে আমিষ বাদ দিচ্ছে। নিম্ন আয়ের মানুষদের বাঁচাতে আমাদের বাজার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। এখন মাছ-মাংস আর সবজির দাম কাছাকাছি, কিন্তু সবজি অল্প পরিমাণে কেনা যায়। কিন্তু মাছ-মাংস চাইলেও অল্প পরিমাণে কেনা যায় না, সেই ব্যবস্থা আমাদের নেই।’

 

এই ভোক্তা অধিকার কর্মীর মতে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পদধারীর পাশাপাশি পুরো প্রক্রিয়ারও পরিবর্তন প্রয়োজন। আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন, ভোক্তার অধিকারের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আর সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

 

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট