চট্টগ্রাম বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

সর্বশেষ:

ঘোর অমানিশা কেটে যাক, নতুন সূর্যের রঙিন আভা ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন

২৫ আগস্ট, ২০২৪ | ১১:৪৮ পূর্বাহ্ণ

একদিকে ভারী বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল; তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ভারতের ত্রিপুরা থেকে ছুটে আসা পানির তোড়। সবমিলিয়ে দেশের পূর্বাঞ্চলের সিংহভাগ এলাকা এখন পানির নিচে। কোথাও কোমরপানি, কোথাও ঘরের চালা ছুঁই ছুঁই। তলিয়েছে সড়ক-মহাসড়ক, রেলপথও। ডুবেছে ফসলের মাঠ, ভেসে গেছে চাষের মাছ। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে আকস্মিক এই বন্যায় কী করতে হবে, কোথায় আশ্রয় নিতে হবে- তাৎক্ষণিকভাবে বুঝে ওঠাই মুশকিল হয়ে গেছে সাধারণ মানুষের জন্য।

 

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা, ধলাই, মনু, খোয়াই, পূর্বাঞ্চলের গোমতী, মুহুরী ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ফেনী, হালদা নদীগুলোর পানি বেড়ে দেশের ১০ জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেটে পরিস্থিতি বেশি অবনতি হয়েছে। অন্যান্য জেলায় ধীরে ধীরে বন্যার অবনতি হচ্ছে। এতে ৩৬ লাখের বেশি মানুষ চরম মানবিক সংকটে পড়েছে। এদিকে ফেনী কবলিত হয়েছে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায়। বিশেষ করে ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরামের অবস্থা বেশি খারাপ। এসব উপজেলার পৌর শহরগুলোও প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী কয়েক লাখ মানুষ। এমনকি ফেনী শহরেও কোনো কোনো বাড়ির নিচতলা প্রায় পুরোটা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। পাহাড়ি ঢল ও বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেতে সোনাগাজী উপজেলার বড় ফেনী নদীর মুহুরী রেগুলেটরের ৪০টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া এলাকায় গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে অন্তত ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টায় এ ঘটনা ঘটে। প্লাবিত গ্রামগুলো হলো বুড়বুড়িয়া, খাড়াতাইয়া, নানুয়ার বাজার, কিং বাজেহুরা, মিথিলাপুর, শিকারপুর, মহিষমারা, ইছাপুরা, পয়াত, গাজীপুর, কণ্ঠনগর, মাওরা, গোপীনাথপুর, জগৎপুর ও গোসাইপুর। পানির তোড়ে ভাঙনের খবরে বাঁধের আশেপাশের শতাধিক পরিবার নিজেদের ঘর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। বুড়বুড়িয়া গ্রামের শতাধিক বাসিন্দা বাড়িঘর হারিয়ে দিশাহারা অবস্থায় আছে।

 

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, রাউজান ও হাটহাজারীতে পানিবন্দী হয়ে আছেন প্রায় তিন লাখ মানুষ। বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, নাজিরহাট, খাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়ক। ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের রামুতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন অন্তত ২৩ হাজার মানুষ। জেলার পেকুয়া উপজেলার শিলখালী ও টৈটং ইউনিয়নের অন্তত ১১টি গ্রামীণ সড়ক ভেঙে গেছে। প্রবল বর্ষণ ও ঢলে ভেসে গেছে পাহাড়ি শহর খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির সমতল ও নিচু এলাকা, খেতখামার ও পুকুর। ডুবে আছে বিস্তীর্ণ এলাকার বসতবাড়ি। খাগড়াছড়ি শহরের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এদিকে কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ে পিএইচডি গবেষক আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ চলমান বন্যার জন্য তিনটি প্রাথমিক কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো- প্রথমত, মৌসুমী লঘুচাপটি বাংলাদেশের উপর স্থায়ী হয়ে আছে। বুধবার বিকালেও এ লঘুচাপটি চট্টগ্রামের অংশে অবস্থান করছিল যা পূর্বদিকে অগ্রসর হচ্ছিল না। এর প্রভাবে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ এলাকায় বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

দ্বিতীয়ত, বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে খুবই স্ট্রংলি ম্যাডেন-জুলিয়ান অসিলেশন (এমজেও) অবস্থান করছে। এর ফলে সাগরে নিয়মিত গরম ও আর্দ্র বাতাস তৈরি হচ্ছে, যা উপক‚লের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। তৃতীয়ত, মধ্য এশিয়ার উপরে ‘জেট স্ট্রিম’ এর অবস্থান রয়েছে। এর ফলে ভারতসহ বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। চতুর্থত, বন্যার পিছনে ভারত বাঁধ খুলে দেওয়া অন্যতম কারণ। ভারী বর্ষণে নদীগুলোর পানি বিপৎসীমায় পৌঁছে যাওয়ায় ভারত বন্যার কবলে পড়েছে। প্রতি বছর ভারত বন্যার আক্রান্ত হলেই তারা বাঁধ খুলে দেয়। এ বছরও তারা কোথাও কোথাও বাঁধ খুলে দিয়েছে এবং কিছু জায়গায় অতিরিক্ত পানির কারণে বাঁধের গেটগুলো ভেঙে গেছে। মোস্তফা কামাল পলাশ ব্যাখ্যা করেছেন, এ তিনটি কারণ একই সাথে ঘটলে তখন ওই এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যায় এবং এর ফলে পাহাড়ি ঢল ও বন্যার সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ দেশে ২০১৭ সালের জুন মাসে এই তিনটি কারণ একই সাথে ঘটেছিল এবং এর কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম। যার ফলে সেই বছর চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে শতাধিক মানুষ মারা গিয়েছিলেন।

 

অপরদিকে, একাধিক সংস্থা ও আবহাওয়াবিদরা গত জুলাইয়ে আশঙ্কা করেছিলেন আগস্টে বন্যা হতে পারে। সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে চলতি মাসের শুরু থেকেই দেশের উপকূলীয় এলাকায় বাড়ে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় একটি লঘুচাপের সৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে জমতে শুরু করে মেঘ। সেই মেঘ ভূখণ্ডে ঢুকে বাড়ায় বৃষ্টির পরিমাণ। তবে বিশেষজ্ঞদের মত, কেবলমাত্র ভারী বৃষ্টি বন্যার একমাত্র কারণ না। ভারত ব্যারেজ খুলে দেওয়ায় উজান থেকে নেমে আসা পানি বাংলাদেশের অন্তত আটটি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাতের অভিমত মতে, ‘আমাদের এখানে বন্যার প্রধানতম কারণ বাংলাদেশ অংশে ভারী বৃষ্টি। পাশাপাশি উজান থেকে পানি এসেছে।’ তিনি বলেন, ‘১৯৬২ সালে কাপ্তাই ড্যাম তৈরির আগে এর ভাটিতে রাউজান কিংবা এর পাশের এলাকায় প্রতি বছর প্রচণ্ড বন্যা হতো। কাপ্তাই ড্যাম হওয়ার পরে বন্যা নিয়ন্ত্রণে আছে। একই ঘটনা গোমতীতেও হচ্ছে। উজানে তারা ড্যাম তৈরি করেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য। গত ৩০-৪০ বছরে এর ভাটিতে কোনো বন্যা হয়নি। ভারতের ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের কুমিল্লা অঞ্চলে বন্যা কমে গেছে’ বলেন তিনি। এই জলবায়ু বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘জলাধারগুলো বর্ষার প্রথমেই পানি দিয়ে ভর্তি করে ফেলার চেষ্টা করা হয়। বর্ষার শেষে বৃষ্টি নাও হতে পারে। বর্ষায় বৃষ্টি হওয়ার কথা, হয়েছে। তবে এবার অস্বাভাবিক অতি বৃষ্টি হয়েছে। ৩০০-৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ভারতেও প্রচুর হচ্ছে। ‘দিল্লিতে আবহাওয়া অধিদপ্তর অরেঞ্জ অ্যালার্ট দিয়েছে। ত্রিপুরা প্রশাসন রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। অর্থাৎ মানুষকে তারা প্রস্তুত করেছে। আমাদের এখানে আবহাওয়া দপ্তর গত ৫০ বছর ধরে যেভাবে বলে চলেছিল, সেভাবেই বলে চলেছে “ভারী বৃষ্টি হতে পারে।’ এটা তো স্থানীয়ভাবে সতর্কবাণী দিতে হবে! এ রকম ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি ঢাকাতেও হতে পারে, বর্ষায় যে কোনো সময় হতে পারে। এ রকম বৃষ্টি ত্রিপুরায় হয়েছে, ফেনীতে হয়েছে’ যোগ করেন তিনি। আইনুন নিশাত বলেন, ‘ত্রিপুরার কিছু পানি নামছে গোমতী দিয়ে, যেটা জলাধারে ধরা ছিল। জলাধার খুলে দিতে হয়েছে, কারণ তাছাড়া জলাধার ঝুঁকি তৈরি করবে। প্রশ্ন হচ্ছে তারা রিজার্ভারের গেট খুলে দিয়েছে কি না? এই তথ্যটা বাংলাদেশকে সঙ্গে সঙ্গে জানিয়েছে কি? গেট খুলে দিতে হতে পারে কিন্তু তথ্যটা আমাদের দিলে আমরা পূর্বাভাস দিতে পারি, প্রস্তুতি নিতে পারি। মনে হয়না তারা জানিয়েছে।’ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ‘মেঘ জমছে, বৃষ্টি হবে সেই পূর্বাভাস আবহাওয়া অধিদপ্তর আগেই দিয়েছিল। অথচ সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের উচিত ছিল অন্তত পাঁচঘণ্টা আগে জানানো যে, আমাদের এখানে পানি বাড়ছে, আমরা ব্যারেজ খুলে দেওয়ার কথা চিন্তা করছি। সেটাও তারা করেনি। ভারতের ব্যারেজ নির্মাণ ঠেকানো সম্ভব না হলেও, আমাদের উচিত ছিল তাদের সমঝোতায় বাধ্য করা যে, তারা পানি ছাড়ার আগে আমাদের জানাবে। কতটুকু পানি ছাড়বে সেই ধারণা দেবে। তাহলে আমরা এক রকম প্রস্তুতি রাখতে পারতাম। পানি কোন দিক দিয়ে যাবে সেটা নির্ধারণ করে জায়গাগুলো খালি রাখা যেত। সেই রুটে অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি-ঘর উঠেছে।’ গওহার নঈম আরও বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম জানে না, বন্যাপরিস্থিতি কেমন হয়। প্রবীণদের দায়িত্ব ছিল তাদের জানানো।’

 

হঠাৎ বন্যায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১২টি জেলায় অচল হয়ে গেছে ৫টি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির প্রায় ২ হাজার ২৫টি টাওয়ার। ফলে এসব এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এতে করে বন্যা কবলিত এলাকায় মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। আশার কথা হলো, ভানবাসিদের উদ্ধারে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে তারা রওনা হয়েছেন নোয়াখালী ও ফেনীর দিকে। পতেঙ্গা ও সীতাকুণ্ড থেকেও স্পিডবোট ভাড়া নিয়ে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছেন অনেকে। পাশাপাশি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকরাও কাজ করছেন। এছাড়া সরগরম হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বন্যায় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আকুতি জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানান ধরণের মানবিক পোস্ট দিচ্ছেন নেটিজেনরা।

 

‘মানুষ মানুষের জন্য’ এ-ই স্লোগানে ব্রত হয়ে আসুন আমরা ভানবাসি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়।মহান আল্লাহর দরবারে শুধু করি এ-ই মিনতি; ঘোর অমানিশা কেটে যাক! পূর্ব দিগন্তে নতুন সূর্যের রঙিন আভা ছড়িয়ে পড়ুক!

 

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।

পূর্বকোণ/এসএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট