খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক সক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার দিন দিন হৃদরোগীর সংখ্যা বাড়ছে। হাসপাতালগুলোতে ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে হার্টের রোগীদের অস্ত্রোপচারের বিকল্প চিকিৎসা দিচ্ছেন না উল্লেখ করে ভারতের খ্যাতিমান হৃদরোগ ও লাইফস্টাইল বিশেষজ্ঞ ডা. বিমল ছাজেড় বলেছেন, ‘শরীর-বুক কাটাছেড়া করে রিং বাইপাস করানো সুস্থ চিকিৎসা নয়। রিং প্রতিস্থাপন না করে, অপারেশন ছাড়া হৃদরোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা সম্ভব। এজন্য হৃদরোগ সম্পর্কে জানতে হবে। হৃদ রোগ কী, কেন ও কীভাবে হয় এবং কী কী উপায়ে প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা যায় তা জানতে হবে।’ সায়েন্স অ্যান্ড আর্ট ফর লিভিং (সাওল) চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে কাজ করা বিশ্বের আন্তর্জাতিক চেইন ‘সাওল হার্ট কেয়ার সেন্টার’ সেই লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
শুক্রবার (৩১ মে) রাজধানীর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল অডিটরিয়ামে ‘বিনা রিং, বিনা অপারেশনে হৃদরোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান বক্তা হিসেবে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন ডা. বিমল। সাওল হার্ট সেন্টার (বিডি) লিমিটেডের উদ্যোগে দিনব্যাপি ‘১৯তম জাতীয় সাওল হার্ট ও লাইফস্টাইল সেমিনার’ অনুষ্ঠিত হয়।
আয়োজকরা জানান, সায়েন্স অ্যান্ড আর্ট ফর লিভিং (সাওল) চিকিৎসা পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করেন আমেরিকার প্রখ্যাত হৃদরোগ ও লাইফস্টাইল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ডিন অর্নিশ। দক্ষিণ এশিয়ায় এই পদ্ধতিটিকে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন ভারতের খ্যাতিমান হৃদরোগ ও লাইফস্টাইল বিশেষজ্ঞ ডা. বিমল ছাজেড়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে এই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচলন শুরু হয় কবি মোহন রায়হানের হাত ধরে। তার প্রতিষ্ঠিত সাওল হার্ট সেন্টার (বিডি) লিমিটেড ‘সাওল হার্ট সেন্টারের’ একটি শাখা। আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৩২টি শাখার মাধ্যমে ‘বিনা রিং ও বিনা অপারেশনে’ হৃদরোগের স্থায়ী চিকিৎসা দিচ্ছে।
সেমিনারে অংশ নিয়ে ডা. বিমল বলেন, বিশ্বে প্রতিবছর যত মানুষ মারা যান, তার ৩০ শতাংশই হার্টের অসুখে। ভারতে প্রতিবছর ১ কোটি মানুষ মারা যায়। এরমধ্যে হৃদরোগে মারা যান প্রায় ৩০ লাখ মানুষ; যা প্রতি তিন জনে একজন। আর বাংলাদেশ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত। নানা রোগে মারা যাওয়া মধ্যে অর্ধেকই হার্টঅ্যাটাকে। এর প্রধান কারণ হৃদরোগের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জ্ঞানের স্বল্পতা। এ দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেই বলা হয়, অপারেশন লাগবে। নয়তো এখনই রোগী মারা যাবে। এভাবে রোগীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অংকের ব্যবসা করা হচ্ছে।
মানুষ যত প্রকৃতির থেকে দূরে সরে যাবে, তত বিপদ তৈরি হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শরীরে যত কম কাটাকাটি করা যায় ততই মঙ্গল। গাছ থেকে একটি পাত ছেড়ার পর আবার যেমন জোড়া লাগানো যায় না। ঠিক একই শরীরের কোন অংশ কাটলে একইভাবে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। হার্টের ক্ষেত্রে তো আরও অসম্ভব। প্রতিবছর হৃদরোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া সফলতার লক্ষণ নয়, বরং এটা ব্যর্থতার লক্ষণ। এক সময় পোলিও, পক্স রোগকে আমরা দূর করতে পেরেছি, এটা সফলতা। হৃদরোগের ক্ষেত্রে সবাই সচেতন ও নিয়ম মেনে চলতে পারলে হার্টঅ্যাটাকে মৃত্যুর হারও শূন্যের কোটায় নিয়ে আসা সম্ভব।
সেমিনার আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মনির সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাবেক উপদেষ্টা ডা. হোসেন জিল্লুর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) হোসেন আব্দুল মান্নান, লেখক ও বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ডা. সলিমুল্লাহ খান ও হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী।
সেমিনারে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে ধনীদের রোগ ও গরীবের রোগ বলে কিছু নেই। একটি জায়গায় আমরা বৈষম্য কমিয়ে আনতে পেরেছি! সেটা হলো হৃদরোগ, এটি ধনী গরিব সবার। এই দৃষ্টিকোন থেকে সাওলের এই চিকিৎসা সমাজের প্রত্যেকের জন্য। সমাজের সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে দেখলে দুইটি বড় ঘাটতি চোখে পড়ে। একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও আরেকটি স্বাস্থ্য সেবা। দুটিই বাণিজ্যকীকরণ হয়ে গেছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে। বাণিজ্যকীকরণের মানসিকতা আমাদের সমাজে গেড়ে বসেছে। স্বাস্থসেবা ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে দিন দিন অনেক রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। এটি বড় একটি সংকট হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।’
সাওল হার্ট সেন্টার (বিডি) লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান কবি মোহন রায়হান বলেন, ‘আমি ২০০৭ সালে হার্টের সমস্যার কারণে ভারতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাকে রিং বাইপাস করতে বলা হয়। কিন্তু আমি হাসপাতালের বুক স্টলে ডা. বিমল ছাজেড়ের ‘হৃদরোগ থেকে মুক্তির সহজ পাঁচ পদক্ষেপ’- বইটি খুঁজে পাই। ওই বইটি পড়ে আমি চমকে যাই। তিনি সেখানে লিখেছেন— আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে উন্নতি ঘটেছে, কিন্তু হৃদরোগের সঙ্গে লড়াই করতে ব্যর্থ হয়েছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান হৃদরোগের চিকিৎসায় কেন ব্যর্থ হয়েছে, সেই কৌতূহল থেকে আমি সারা রাতে বইটি পড়ে শেষ করি। সকালে উঠে সিদ্ধান্ত নেই, আমি বাইপাস করাবো না। পরে আমি দেশে ফিরে এসে সাওল পদ্ধতি প্রয়োগ করে নিজে নিজেই সুস্থ হয়ে উঠি। পরে আবার ভারতে গিয়ে ডা. বিমল ছাজেড়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসি। ২০০৯ থেকে বাংলাদেশে সাওলের পথযাত্রা শুরু হয়।’
নিজের সেন্টার প্রতিষ্ঠার গল্প তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমি বিত্তবান নই। এই সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নিজের এক টুকরো জমি বিক্রি করেছি। মানুষের কাছ থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিয়েছি। সাওলকে একটি আন্দেলনে পরিণত করার চেষ্টা করছি। বড় বড় হাসপাতালগুলোতে অপারেশন না করালে রোগী যেকোনও সময় মারা যাবে— এমন ভয় দেখিয়ে কয়েক লাখ মানুষের বুক কাটছে, পকেট কাটছে। আমরা সাওলের মাধ্যমে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সচেতন করতে চাই। আমরা চাই, ভবিষতে বাংলাদেশের একটি মানুষও হার্টঅ্যাটাকে মারা না যাক। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
পূর্বকোণ/পারভেজ