চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

আগরতলা মামলা ঃ মিথ ও বাস্তবতা

নাওজিশ মাহমুদ

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:১১ পূর্বাহ্ণ

১৯৬৫ সালের পাকিস্তান ভারতের যুদ্ধের মধ্যদিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে অরক্ষিত রেখে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষানীতির বৈষম্য জনগণের সামনে চলে আসে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানের সমস্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক। পূর্ব-পকিস্তানের প্রতিরক্ষা ছিল একেবারে দুর্বল। ভারত যদি ইচ্ছা করতো সহজে পূর্ব-পাকিস্তান দখল করে নিতে পারতো।

যুদ্ধ সীমাবদ্ধ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে এবং ভারতের পশ্চিম সীমান্তে। এই যুদ্ধ কে প্রথম শুরু করেছে তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে এই নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কাশ্মীর। এই কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত পাকিস্তান কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি না হওয়ায়, ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক কোনদিন স্বাভাবিক হতে পারেনি। সেই অস্বাভাবিক সম্পর্ক যুদ্ধ পর্যন্ত গড়িয়েছে কিন্তু কোন সমাধান হয়নি। সেরা সমাধান হতে পারতো কাশ্মীরী জনগণের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষাকে সম্মান জানানো হলে। উচিত ছিল কাশ্মীরকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে উভয়ের স্বীকৃতি প্রদান। এতে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা খাতে অনেক অর্থ বেঁচে যেত এবং একটি সুখী সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে বিশে^ অনন্য নজির স্থাপন করতে পারতো। কাশ্মীরকে নিয়ে ১৯৬৫ সালে যুদ্ধ করতে গিয়ে ভারত-পাকিস্তানের কোন লাভ না হলেও পাকিস্তান তাঁর ভবিষ্যৎ কণ্টকাকীর্ণ করে ফেলে। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব-পাকিস্তানের মধ্যে যে অবিশ^াসের বীজ রোপিত হয়, তার প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব-পাকিস্তান আলাদা হয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে পরিণত হয়।

১৯৬৫ সালে কাশ্মীর, লাহোর এবং খেমকারান এই তিনটি সেক্টরে প্রচ- যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তান খেমকারানে বিশাল অঞ্চল দখল করে নেয়। অপরদিকে ভারতীয় বাহিনী লাহোর বিমান বন্দরের নিকট পৌঁছে যায়। যেকোন দেশের বিপর্যয়ের পূর্বেই বৃহৎ শক্তিসমূহের হস্তক্ষেপে উভয় দেশ যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধবন্ধের পর একটি চুক্তি করতে জাতিসংঘ, আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রচ- চাপ দেয়। তাঁদের পক্ষ থেকে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকলাই কোসিগিন এই উদ্যোগ নেন। উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রির মধ্যে কোসিগিনের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে ভারত ও পাকিস্তানকে তাঁদের পূর্বের চুক্তি মেনে চলতে বাধ্য করেছিল। একে অপরের অধিকৃত অঞ্চল ছেড়ে দিতে এবং ১৯৪৯ সালের যুদ্ধ বিরতির সীমান্ত চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার করেছিল। দুই দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপন এবং জনগণের মধ্যে সৌহার্দ্য বৃদ্ধি তাসখন্দ চুক্তির মূলকথা। শক্তি প্রয়োগ না করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার উপর জোর দেয়া হয়। পরস্পরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার, কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্ররোচনায় উৎসাহ না দেয়া, ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন মেনে চলার ব্যাপারেও একমত হন। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনরায় চালু করার বিষয়েও বিবেচনা করবেন বলে সম্মত হন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধবন্দী বিনিময় ও দখলকৃত সম্পদ ফেরতের ব্যাপারে অঙ্গীকার করেন।

চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এ রহস্যের নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কাছে বিশ^াস জন্মায় পাকিস্তান এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে যাচ্ছে, তাসখন্দ চুক্তি তাঁদের বিষ্ময়ের জন্ম দেয়। তার উপর কাশ্মীর প্রশ্নে কোন কিছু উল্লেখ না থাকায় জনগণের মাঝে প্রতিক্রিয়া বিরূপ আকার ধারণ করে, এ চুক্তির শর্তাবলী প্রকাশ না করার কারণে। এই সূত্র ধরে পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ এবং দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। ভুট্টো চুক্তির বিরোধিতা করায় তাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে অপসারণ করা হয়। ভুট্টো জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হন। পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব খানের জনপ্রিয়তায় ধস নামে।

এই যুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকেরা খেমকারান সেক্টরে এবং লাহোর সেক্টরে অপরিসীম বীরত্বের পরিচয় দেয়। বিমান বাহিনীর বাঙালি বৈমানিকরা দক্ষতার পরিচয় দেয়। এই বীরত্বের ফলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীর বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে আত্মবিশ^াস জেগে উঠে। এমনিতে বাঙালিরা পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর পাঞ্জাবী সৈনিকদের কাছ থেকে অবহেলা ও অবজ্ঞার শিকার হতো। তাঁদের কাছ থেকে নির্যাতন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বাঙালি সৈনিকেরা এর ফলে এক ধরনের হীনম্মণ্যতায়ও ভুগতো। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে বাঙালি সৈনিকদের বীরত্ব এবং আত্মত্যাগ তাঁদের মধ্যে হীনম্মণ্যতা কাটিয়ে উঠে আত্মবিশ^াসে বলিয়ান হয়ে উঠে। অরক্ষিত রাখার প্রতিরক্ষা নীতির ফলে পূর্ব-পাকিস্তানেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। বুদ্ধিজীবী, তরুণ এবং ছাত্রসমাজের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রয়া হয়। এই প্রতিক্রিয়া প্রতিরক্ষা বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের মধ্যে সংক্রমিত হয়। ঘৃণার জন্ম দেয়। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের আকাক্সক্ষা জাগ্রত হয়। এই আকাক্সক্ষা থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন করার যে কোন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে। সেখান থেকে বাঙালি সৈনিকেরা পূর্ব-পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার গোপন সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় জড়িত হয়ে পড়ে। কিন্তু এই ধরনের চিন্তাভাবনা ও কর্মকা- হঠকারিতা হলেও স্বাধীনতার জন্য উদগ্রীব এক দল স্বাধীনতাকামী আত্মত্যাগে প্রস্তুত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নেয়। এই গোপন প্রক্রিয়ায় বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী এবং সেনা অফিসার ও সৈনিকরা সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তান আমলাতন্ত্রের বাঙালি উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একটি অংশ স্বাধীনতার জন্য উদগ্রীব থাকলেও সেনাবাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিল বলে মনে হয় না। তাঁরা বরঞ্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে হয়তো রাজনৈতিক যোগাযোগ রাখতেন। আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ এবং পাকিস্তান উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তথ্য বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন।
বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি গোপনে ভারতের সাথেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। এই জন্য আগরতলায় স্বশরীরে গমনও করেছিলেন। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল।

তাসখন্দ চুক্তির প্রতিবাদে এবং পাকিস্তানের জনগণের মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে আইয়ুব বিরোধী একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট এবং কর্মসূচী নির্ধারণের জন্য ১৯৬৬ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সকল বিরোধী দলের নেতাদের সর্বদলীয় বৈঠকে বসে। তখন পাকিস্তানে সর্বজনগ্রহণযোগ্য কোন নেতা নেই। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য বিরোধী দলীয় নেতা। ১৯৬৩ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রহস্যজনক মৃত্যুর পর পাকিস্তানের উভয় অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য আর কোন নেতৃত্ব গড়ে উঠে নাই। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিপক্ষে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর ভগ্নি ফাতেমা জিন্নাহকে সকল বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী করলেও তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন নি।১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের দুই অংশের চিন্তা-চেতনা ও উপলব্ধির বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ কাশ্মীর দখল করতে না পারা ও তাসখন্দ চুক্তির অপমানের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। আর পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক আধিপত্য এবং বহির্শত্রু অরক্ষিত প্রতিরক্ষার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তাই, অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের জন্য বাঙালি অর্থনীতিবিদদের পাকিস্তানের দুই অর্থনীতির তত্ত্বের আলোকে, আলাদা মুদ্রা অথবা আলাদা রিজার্ভ ব্যাংকের মাধ্যমে পুঁজি পাচারে পথ বন্ধ করার ব্যবস্থাসহ বিকল্প প্রতিরক্ষার ব্যবস্থার প্রস্তাব দেন। যাতে পূর্ব-পাকিস্তানকে অরক্ষিত থাকতে না হয়।

প্যারামিলিটারী গড়ার মাধ্যমে জনগণের সেনাবাহিনী করার প্রস্তাব দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লাহোরের সর্বদলীয় বৈঠকে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ তথা বাঙালির পক্ষ থেকে ৬ দফার পেশের মাধ্যমে এর অথনৈতিক বৈষম্য নিরসন এবং অরক্ষিত প্রতিরক্ষার সমাধানের লক্ষে শুধু প্রতিকার চেয়েছেন। আইয়ুব খানের পতনের আন্দোলনের পূর্বে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সমর্থন চেয়েছেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা সমর্থন দেয়া তো দূরের কথা, এই ৬ দফাকে প্রত্যাখ্যান করে বিচ্ছিন্নতার দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ফলে কোন সিদ্ধান্ত ছাড়া এই বৈঠক ভেঙে যায়।
আইয়ুব খান এই বৈঠকের দ্বন্দ্ব কাজে লাগিয়ে তাঁর সমর্থন ধরে রাখার জন্য ৬ দফা বিরোধী প্রচারণায় নামেন। একে বিচ্ছিন্নতার হাতিয়ার হিসেবে ৬ দফাকে আখ্যায়িত করেন। ৬ দফার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দিনসহ পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তার করেন। পূর্ব-পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন চালায়। আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন হরতাল আহ্বান করে। হরতালে ছাত্র-জনতার সাথে ব্যাপক শ্রমিক শ্রেণির অংশগ্রহণ করে। ফলে হরতাল নতুন মাত্রা পায়।

হরতালে পুলিশের গুলিতে ১১জন শহীদ হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান সরকার হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। ৬ দফা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তার বাধা দিতে নতুন কৌশল আঁটে। (আগামি রবিবার সমাপ্য)

লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট