[এ যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জিত হবে না, সামরিক চাপের মাধ্যমে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা যাবে না, নিরাপত্তাহীনতা থেকেই যাবে আর ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক বর্বরতারও শেষ হবে না]
আমরা হেরে গেছি। সত্য বলতেই হবে। এটি স্বীকার করার সক্ষমতা ইসরায়েলের ব্যক্তি এবং গণমানুষের অর্জন করতেই হবে। আমাদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এটা মোটেই ভালো কিছু নয় যে, আমরা পরাজয় মেনে নেয়ার মানসিকতা ধারণ করতে না পেরে নিজেদের ‘মিথ্যা’ দিয়ে ঢেকে ফেলি। আমাদের কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলি, কেউবা নিজেদের প্রবোধ দেবার জন্যে সেই মিথ্যার আশ্রয় নিই। সান্ত¡না খুঁজতে হবে বাস্তবতার নিরিখে, নইলে পস্তানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। মনে রাখতে হবে- সবসময় ভালোরাই জিতবে- এমনটি না-ও হতে পারে।
আমার প্রিয় বই গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ’র ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’। এখানে হিরো ফ্লোরেন্তিনো আরিজা দীর্ঘ ৫১ বছর পরও তার মূল ‘ভালোবাসা’র (ফারমিনা দাজার) সাথে তার প্রেমের পূর্ণতা দিতে পেরেছিল। এখানে তাদের প্রেম-পর্ব ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনে ছিল নিশ্চিতভাবে সফল।
জীবন আসলে এমনি। কখনও কখনও এর একটি ভাল সমাপ্তি আছে। কিন্তু প্রায়ই সমাপ্তিটা সুখকর হয় না। যুদ্ধগুলিও এমনই হয়।
অর্ধেক বছর পরে, আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গায় থাকতে পারতাম। কিন্তু আমরা দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ নেতৃত্বের কাছে জিম্মি হয়ে আছি- বলতে হেলে এটি সমস্ত বিশে^ই সর্বকালের সবচেয়ে খারাপ নেতৃত্বের উদাহরণ। সাধারণভাবে প্রতিটি সামরিক উদ্যোগের সমাপ্তিটা হয় একটি সুবিবেচিত উন্নত কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে। কিন্তু আজকের ইসরায়েলে সেরূপ কোনো কূটনৈতিক তৎপরতার দেখা নেই।
এটি একজন নেতার জন্য মোটেই সুখকর কিছু নয়, যার নেতৃত্ব বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। এমন একজন ব্যক্তির হাতে আজকের ইসরায়েলের শাসনভার- যার ‘কমনসেন্সের’ অভাব বড়োই প্রকট। দু:খজনক যে, তবুও ভোটাররা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রতিই তাদের আস্থা রেখেছেন ৩২টি নেসেট আসনে।
সত্যি কথা বলতে কি, আমরা আরও ভাল জায়গায় থাকতে পারতাম। যুদ্ধের প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই যদি হামাসকে দ্রুত নির্মূল করার জন্য আরো দ্রুত শক্তিশালী, আক্রমনাত্মক- বিশেষভাবে ন্যায্য প্রচারণা চালানো যেতো। যেখানে জড়িত থাকতো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে বৈশ্বিক এবং আরব সমর্থন সহ অন্যান্য দেশগুলো। তাদের সহায়তা নিয়ে গাজায় হামাসের একটি কার্যকর বিকল্প তৈরি করতে পারতাম আমরা। প্রতিদিন এবং প্রতি মিনিটে, আরও ভাল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ আমরা হাতছাড়া করেছি। কিন্তু আমরা এমন একজন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করেছি- যার নামের সাথে ‘মামলা’ ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত।
কিন্তু আমরা ওসব কিছুই বলতে পারবোনা। সত্য এটাই- আমরা হেরে গেছি। লোকেদের মধ্যে সেরাতে বিশ্বাস করার এবং আশাবাদী হওয়ার প্রবণতা রয়েছে, এই আশায় যে আগামীকাল ঠিক হবে, আমরা এমন একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি যা শেষ পর্যন্ত আরও সফল হবে। এটি মানুষের চিন্তার সবচেয়ে মৌলিক ব্যর্থতা। আমরা এখন যে বিশ্বাস ধারণ করছি মনে- এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র যে, জিম্মিদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে , হামাস আত্মসমর্পণ করবে, ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করা হবে, কিংবা আমরা ভাল ছেলেরা-তাই বিজয় আমাদেরই হবে অথবা ‘ইরানের শাসন’ শীঘ্রই বিস্ফোরিত হবে- এ সব কিছুই কিন্তু সত্য নয়। সর্বোপরি, জনগণকে সত্য বলা অস্বস্তিকর।
এটা বলা অপ্রীতিকর, কিন্তু আমরা নিরাপদে ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে ফিরে আসতে পারব না- এটাই সত্যি।
একজন সাংবাদিক হিসাবে ৭ অক্টোবর থেকে আজ (১১ এপ্রিল ২০২৪) পর্যন্ত ঘটনা-পরম্পরায় আমার উপসংহার হল এককথায় ‘অস্বস্তিকর’। আমাদের নিরাপত্তা এবং এখানে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক জিনিসটা হল- ‘ভাল বোধ করার নেশা’-এটা বিপজ্জনক। আমাদের সত্য বলতে হবে- এমনকি যখন এটি অস্বস্তিকর হয়, এমনকি যখন এটি কষ্টকর, এমনকি যদি কিছু লোক এটিকে নিন্দা করে, এমনকি যদি এটি মনোবল হ্রাস করে-তখনো।
আমাদের বিবি-ইস্ট প্রোপাগান্ডা মেশিনের (নেতানিয়াহু) বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। এটা বলা অপ্রীতিকর যে, আমরা আর ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে নিরাপদে ফিরে যেতে পারব না, যা আগে ছিল। হিজবুল্লাহ সেই সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে। আমাদেও প্রস্তুত থাকতে হবে শোনার জন্য যে, সমস্ত জিম্মি জীবিত বা মৃত ফিরে আসবে না। কিছু হদিস হারিয়ে গেছে, এবং তাদের ভাগ্য অজানা থেকে যাবে। তাদের স্বজনরা দুশ্চিন্তা, ভয় ও শঙ্কায় অসুস্থ হয়ে ঘুরে বেড়াবে। সময়ে সময়ে, আমরা তাদের স্মৃতিতে বেলুন চালু করব। কোনো মন্ত্রিপরিষদ মন্ত্রী আমাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অনুভূতি ফিরিয়ে আনবেন না। ইরানের প্রতিটি হুমকিতে আমরা কেঁপে উঠবো। আমাদের নেতৃত্বের দুর্বলতা বাইরের কাছে প্রকাশ পেয়েছে। বছরের পর বছর ধরে আমরা তাদের বোকা বানাতে পেরেছি যে আমরা একটি শক্তিশালী দেশ, একটি জ্ঞানী মানুষ এবং একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর দেশ।
প্রকৃতপক্ষে, এর প্রায় সবটাই ভ্রান্ত ধারণা। পরাজয় স্বীকার করে নেয়া ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জন্য সত্যিই কঠিন। সামরিক বাহিনী সম্পর্কে খারাপ কিছু বলা যাবে না। আমাদের সৈন্যরা প্রকৃতপক্ষে সিংহ। তারা যুদ্ধ করেছে, সৈনিক হিসাবে দক্ষতা প্রদর্শন করেছে এবং চিত্তাকর্ষক কৌশলগত সাফল্য অর্জন করেছে। আমাদের পরাজয়ের অর্থ এই নয় যে তারা ভাল সৈনিক নয়, তারা চেষ্টা করেনি, তারা তাদের জীবন প্রদান করেনি বা তাদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করেনি। আসলে তারা যা করছে তার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। এর অর্থ হল সামরিক সক্ষমতা এবং রাজনীতিবিদদের আচরণের সমন্বয় একটি প্রতিকূল ফলাফল তৈরি করেছে।
কিন্তু এসব প্রকাশ্যে প্রকাশযোগ্য নয়। তাই আমরা নিজেদের বোকা বানাচ্ছি। মিথ্যা এবং প্রতারণার মেশিন-নির্ভর একটি রাজনৈতিক শিবির রয়েছে যার বেঁচে থাকা অনেকটা ‘জয়’ এর উপর নির্ভর করে। সেই শিবিরটি অনেক আগেই সত্য ও বাস্তবতার সাথে সমস্ত যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছে। আমরা এর নেতা, সেই মানব পিনোচিওকে চিনতে পেরেছি। কয়েক মাস ধরে, তিনি ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ এবং ‘জয় থেকে এক ধাপ দূরে’ থাকার কথা বলছেন। এবং কয়েক মাস ধরে, তিনি বলছেন যে আমরা রাফাতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি ‘এখনই,’ আগামীকাল, আগামীকাল, আমি এখানে যাচ্ছি। এই নেতানিয়াহুর একটি কথাও বিশ্বাসযোগ্য- তা আমি আর মনে করিনা।
সম্প্রতি ডানপন্থি চ্যানেল ১৪ ভূমিকা নিয়েছে নতুন প্রপাগান্ডা মেশিনের। এই সপ্তাহে চ্যানেলটি লোকেদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল- ‘বিজয় হাতে এসেছে’। তাহলে কি রাফাহ আক্রমণ করা থেকে ইসরায়েল বিরত থাকছে?.. মোটেইনা। অন্তত: দেশটির প্রধানমন্ত্রী নিজেও অনেকবার বলেছেন যে, আমরা রাফাহ-অভিযান অবশ্যি করবো, এটা আমাদের করতেই হবে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিপরীতে গিযে হলেও আমরা তা করব।
রাফাহ হল নতুন ব্লাফ যা ‘মুখপত্রগুলি’ আমাদের বোকা বানানোর জন্য চালাচ্ছে এবং আমাদের ভাবতে বাধ্য করছে যে বিজয় আর মাত্র কয়েক মুহূর্ত দূরে। যখন তারা রাফাহতে প্রবেশ করবে, প্রকৃত ঘটনাটি তার তাৎপর্য হারিয়ে ফেলবে। এই অনুপ্রবেশ হতে পারে- মে মাসে। নিশ্চিতভাবেই এর পরে, তারা পরবর্তী মিথ্যা কথাটি বলবে।
বাস্তবতা হচ্ছে- যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। হামাসকে নির্মূল করা সম্ভব হবে না। সামরিক চাপের মাধ্যমে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার দাবিও হবে ব্যর্থ। নিরাপত্তাও পুন:প্রতিষ্ঠিত হবে না।
মুখপত্রগুলো যত বেশি চিৎকার করে যে ‘আমরা জিতছি’, ততই পরিষ্কার যে, আসলে আমরা হেরে যাচ্ছি। মিথ্যা বলা তাদের কৌশল। আমাদের এটিতে অভ্যস্ত হওয়া দরকার। ৭ অক্টোবরের আগের তুলনায় জীবন এখন অনেক কম নিরাপদ। আমরা যে মার খেয়েছি তা আগামী বছরেও আমাদের দংশন করবে। আন্তর্জাতিক বর্বরতা দূর হবে না। এবং, অবশ্যই, মৃতরা ফিরে আসবে না। কিংবা অনেক জিম্মিও (ফিরে আসবে না )।
আমাদের মধ্যে কারো কারো জীবনে আবার স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে, আসন্ন অঘটনের পুনরাবৃত্তিসহ। কারো কারো জীবনে স্বাভাবিকতা আর কখনোই ফিরবে না। সেই লোকেরা মৃতের মতো আমাদের মাঝে হাঁটবে। এমন বাস্তবতার জন্যেই হয়তো আমরা ভোট দিয়েছি। আমাদের এখন স্বদেশের দুঃখজনক এ বাস্তবতায় অভ্যস্ত হওয়া ছাড়া আর উপায়টাই বা কী?
[লেখক : বহুল প্রচারিত ইসরায়েলি মিডিয়া হারেটজ’র সাংবাদিক। নিবন্ধটি, ১১ এপ্রিল, ২০২৪ তারিখ ছাপা হয়]