ইরান আর ইসরায়েলের শত্রুতা সবসময় ছিলো না। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের আগে দু’দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। ইরানে যারা বিপ্লব করেছিলেন তারা ইসলামের অনেক শরিয়া নীতি প্রবর্তন করেছিলেন। এই কারণে ইসরায়েলের সাথে ইরানের সম্পর্ক খারাপ হয়নি। সম্পর্ক খারাপ হয়েছিলো খোমেনি এবং তার ঘনিষ্ঠ সহচরদের আমেরিকা ও আমেরিকার দোসরদের সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরোধিতার কারণে তারা মনে করতেন এই নীতি সারাবিশ্ব জুড়ে অন্যায় অবিচার চালিয়ে যাচ্ছে যার বড় শিকার প্যালেস্টাইন। তারা বিশ্বাস করতেন অত্যাচারীদের বিপক্ষে দাঁড়ানো ইসলামের শিক্ষা। তারা তাদের বিশ্বাস প্রকাশ্যে প্রচার করতেন অত্যাচারী ও দখলদার ইসরায়েলের টিকে থাকার কোন অধিকার নেই। খোমেনির মৃত্যুর পর ইরানী নেতৃত্বের মনোভাব কিছুটা নমনীয় হলেও তারা প্যালেস্টাইনের স্বাধিকারের ব্যাপারে আপোষহীন থেকেছেন এবং আমেরিকা, আমেরিকার দোসর পশ্চিমা দেশগুলো ও ইসরায়েল ইরানকে ইসরায়েলের অস্তিত্বের উপর সবচেয়ে বড় হুমকি ভেবেছে।
আমেরিকা নানা ভাবে ইরানকে অবদমিত করার চেষ্টা করেছে। ১। অর্থনৈতিক অবরোধ। ২। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো থেকে ইরানকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা। ৩। ইরাকের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ইরানকে দুর্বল করার চেষ্টা। ৪। ইরানের শাসকগোষ্ঠী পরিবর্তনের চেষ্টা।
এসব চেষ্টায় ইরান মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের উন্নতি ব্যাহত হয় এবং তারা আরব বিশ্বের শত্রুতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে কিছু ব্যাপার ঘটে। ১। ইরান নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখে। ২। বিশ্বে আমেরিকার প্রভাব দুর্বল হতে শুরু করে। ৩। পশ্চিমা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রাশিয়া ও চীন জোট বাঁধে (BRICS, Shanghai Cooperation Organization, ইত্যাদি)। ইরান এসব জোটে তৃতীয় শক্তিশালী অবস্থানে এসে দাঁড়ায় (ভারত এখনো দুই নৌকায় পা দিয়ে রেখেছে)।
এই পটভূমিতে গতবছরের অক্টোবরে আসে হামাসের আক্রমণ এবং শুরু হয় ইসরায়েলি গণহত্যা। বিশ্ব জনমত ইসরায়েলের বিপক্ষে দাঁড়ায়, আমেরিকা ও পশ্চিমা কিছু দেশের শাসকশ্রেণী বাদ দিয়ে ইসরায়েল একঘরে হয়ে পড়ে। ইসরায়েলের জন্মের পর এই প্রথমবারের মতো তাদের মেকি ও জোরজবরদস্তির অস্তিত্ব টিকে থাকার সংকটের মুখোমুখি দাঁড়ায়। ইসরায়েলি নেতৃত্ব ভাবে তারা এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারবে এক সময়, কিন্তু তাদের প্রধান শত্রু ইরানকে ধ্বংস করতে হবে, এই কাজ তারা একা করতে পারবে না, আমেরিকাকে দিয়ে করাতে হবে, ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকাকে যুদ্ধ করতে হবে। আমেরিকা ইরানকে ধ্বংস করে দিকÑ এই ইচ্ছা ইসরায়েলের বহুদিনের। কিন্তু আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজি নয়Ñ আমেরিকার প্রধান শত্রু ইরান নয়, আমেরিকার প্রধান শত্রু হচ্ছে চীন ও রাশিয়া। তাছাড়া আমেরিকা জানে, যুদ্ধে ইরানকে পরাজিত করা সম্ভব নয়, তারা ইরাক, আফগানিস্তানকে পরাজিত করতে পারেনি, ইরান তো এসব দেশের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ইসরায়েল অবশ্য মনে করে, ইরান যদি ইসরায়েল আক্রমণ করে তবে আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য হবে। এই বিশ্বাসে ইসরায়েল এপ্রিলের ১ তারিখ সিরিয়ায় ইরানের এম্বেসিতে আক্রমণ করে ইরানের কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা হত্যা করে এবং ইরানকে ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করতে বাধ্য করে।
ইসরায়েল এর আগেও না না ভাবে ইরানকে উস্কানি দিয়েছে, যেমন তারা কয়েক বছর আগে ইরানের সবচেয়ে বড় পারমণু বিজ্ঞানি ফকিরজাদেকে হত্যা করেছে, আইসিসকে দিয়ে ইরানে সন্ত্রাস করেছে। তেহরানের ইমাম হোসেন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ও আইআরজিসি অফিসার ফকিরজাদে (৫৯) ছুটিশেষে ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর সস্ত্রীক স্বদেশে ফেরার পথে নিহত হন। ইরান সেসব অগ্রাহ্য করেছে, কারণ তারা এই মুহূর্তে সরাসরি সংঘাতে জড়াতে চায়নি – তারা বিশ্বাস করতো, ইসরায়েলের উস্কানি এক ধরণের ফাঁদ, তাদের শত্রু একসময় নিজে থেকেই দুর্বল হবে আর তারা নিজেরা আরও শক্তিশালী হবে। কিন্তু এবার ইরান ইসরায়েলের উস্কানির জবাব দিতে বাধ্য হয় কিছু কারণে।
১। ইরান নিজের শক্তিতে বিশ্বাসী একটা গর্বিত জাতি। তাদের সভ্যতা অনেক পুরনো। ইরানের জনমত অপমানের প্রতিশোধ চেয়েছে স্বভাবতই। ২। ইসরায়েলি হত্যার জবাব না দিলে ইরানকে দুর্বল মনে হবে, ইসরায়েল আরও বড় কিছু করার সাহস পাবে।
ইরান কীভাবে জবাব দিয়েছে? খুব ভেবেচিন্তে। ইরানের ভাবনা হচ্ছে, আমি সর্বাত্মক যুদ্ধে এই মুহূর্তে জড়াতে চাই না, জড়ালে আমার অনেক ক্ষতি হবে, কিন্তু আমি তোমাকে জানাতে চাই যে, আমি চাইলে তোমাকে ধ্বংস করে দিতে পারি, অতএব আর বাড়াবাড়ি করো না। ইরান সেই প্রমাণ রেখেছে। তারা পৃথিবীর সবচেয়ে “দুর্ভেদ্য” প্রতিরক্ষা বুহ্য, যা Iron dome নামে পরিচিত, তা ভেদ করে দেখিয়েছে যে আমার সাথে আর লাগতে এসো না, আমি মরলে তুমিও মরবে। এটাকে ইংরেজিতে বলে deterrence।
পারমাণবিক শক্তি বাদ দিলে ইরান সামরিক শক্তিতে ইসরায়েলের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ইসরায়েল ইরানের চেয়ে নব্বুই গুণ ছোট একটা দেশ। ইরানের পক্ষে তাই ইসরায়েলকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা সম্ভব, কিন্তু ইসরায়েলের পক্ষে তা সম্ভব নয়, এমনকি পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে।
আমেরিকা এবং ইসরায়েল নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছে। ৭৬ বছর একটা কৃত্রিম রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘ সময়। আমেরিকার সাম্রাজ্য পতনের জন্য আরও দশ থেকে বিশ বছর সময় লাগবে।
লেখক : নিউজিল্যান্ড প্রবাসী চিকিৎসক