চট্টগ্রাম সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

সৌন্দর্যহানি করে সৌন্দর্যবর্ধন নয়

মিজানুর রহমান

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ | ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ

ছোট শহর হলেও চট্টগ্রামকে আমরা সাজাতে পারিনি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছেমতো সাজাতে গিয়ে এ শহরকে শ্রীহীন করে ফেলেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে- সৌন্দর্যবর্ধন মানে গাছ কেটে একাকার করে ফেলা নয়। ইট-পাথরের জঞ্জাল তৈরি করা নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যহানি করে এমন সৌন্দর্যবর্ধন আমরা চাই না। সৌন্দর্যের মাপকাঠি ঠিক করে সৌন্দর্য বুঝে, এমন লোকদেরকে এ কাজগুলোতে সম্পৃক্ত করা জরুরি।

প্রতিষ্ঠার ৩৯ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে দৈনিক পূর্বকোণের বিশেষ ক্রোড়পত্রের জন্য আয়োজিত ‘পরিকল্পিত চট্টগ্রাম নগরী : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় আলোচকরা এসব কথা বলেন। স্থপতি আশিক ইমরানের সঞ্চালনায় আলোচনার শেষ পর্বে ‘সৌন্দর্যবর্ধন: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক বিষয়ে মতামত দেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিরা।

 

গোলটেবিল আলোচনায় স্বাগত বক্তব্যে দৈনিক পূর্বকোণ সম্পাদক ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ছোট্ট একটা শহর চট্টগ্রাম। এরপরও আমরা চট্টগ্রামকে সাজাতে পারিনি। অথচ ঢাকা শহরের কিছু জায়গা দেখলে চেনাও যায় না। সেখানে এ ধরনের উন্নয়ন হয়েছে। তাহলে আমরা কেনো পারব না? আমাদেরতো সবকিছুই আছে। শুধু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তিনি বলেন, সৌন্দর্যবর্ধন করতে হলে এরমধ্যে সৌন্দর্য থাকতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় চট্টগ্রাম শহরে তেমনটা হচ্ছে না। এখানে মৌলিক বিষয়গুলোতেই সমস্যা আছে। এসবের সমাধান না করেই সৌন্দর্যবর্ধনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। আমাদেরকে প্রথমেই সৌন্দর্যের মাপকাঠি ঠিক করতে হবে। যারা সৌন্দর্য বুঝে, এমন লোকদেরকে এ কাজগুলোতে সম্পৃক্ত করা জরুরি।

ভাস্কর অলক রায় বলেন, চট্টগ্রাম শহরকে দৃষ্টিনন্দন করতে চাইলে এ শহরকে সবার ভালোবাসতে হবে। এর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে বুঝতে হবে। সর্বোপরি বাণিজ্যিক মানসিকতাকে দূরে রাখতে হবে। নানা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের হাতে চট্টগ্রামের ভাগ্য ছেড়ে দিলে হবে না। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নকশা বাছাই করতে হবে। পরিকল্পনা করতে হবে সুদূরপ্রসারী।

সিনিয়র সাংবাদিক ওসমান গণি মনসুর বলেন, সৌন্দর্যবর্ধনে পাঁচটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এক- চট্টগ্রাম শহরে পর্যাপ্ত কবরস্থান দরকার। দুই- চট্টগ্রামে পার্কের বিষয়ে আমাদের এখন থেকেই চিন্তা করতে হবে। তিন- যেকোনো মূল্যে খেলার মাঠ বাড়াতে হবে। চার- পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা জরুরি। পাঁচ- পরিবেশের ইস্যুগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

 

তিনি বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিনষ্ট করে চট্টগ্রামে অনেক নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। আমরা এমন একটা অদ্ভুত শহরে বসবাস করছি যেখানে অদ্ভুত সব মানুষের উপর শহর চালানোর দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। আমি মনে করি সৌন্দর্যবর্ধনে চট্টগ্রামে যত সুযোগ আছে ঢাকায় তার অর্ধেকও নেই। শুধুমাত্র মেধার বিকাশ ঘটালেই এখানে অনেক কিছু করা সম্ভব।

 

চুয়েটের শিক্ষক মো. শাহজালাল মিশুক বলেন, চট্টগ্রাম শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের চেয়ে ইটপাথরের স্থাপনা তৈরিতে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। এখানে প্রকল্প নেওয়া হয়। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় সৌন্দর্যের নামে স্থাপনা তৈরি হয়। এরপর আমরা জানতে পারি। তখন আর মতামত দেওয়ার সময় বা সুযোগ থাকে না। সৌন্দর্যবর্ধন করতে গেলে একটা স্ট্যান্ডার্ড মানা লাগে।

 

তিনি বলেন, বিপ্লব উদ্যানে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে কি হচ্ছে জনসাধারণ, পেশাজীবী, নগর পরিকল্পনাবিদ এমনকি এটার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক বিভাগই অবগত নয়। সৌন্দর্যবর্ধন মানে গাছ কেটে একাকার করে ফেলা নয়। ইট-পাথরের জঞ্জাল তৈরি করা নয়। এমন সৌন্দর্য আমরা চাই না। পরিকল্পিত চট্টগ্রাম গড়তে পারলে সৌন্দর্যবর্ধন একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আসবে।

 

চসিকের নগর পরিকল্পনাবিদ আবদুল্লাহ আল ওমর বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইচ্ছেমতো সাজাতে গিয়ে চট্টগ্রাম নগরীকে শ্রীহীন করে ফেলেছে। কিছু কিছু জায়গায় আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। এর মধ্যেও চসিক অনেক কাজ করছে। সৌন্দর্যবর্ধন নিয়ে যতই বলি না কেন, আগে আমাদের শহরবাসীকে ঠিক হতে হবে। ব্যক্তিগত সমালোচনা না করে কাজের সমালোচনা করা উচিত।

 

সিডিএ’র স্থপতি গোলাম রব্বানী চৌধুরী বলেন, আমরা মনে করি রাস্তার পাশে যা দেখছি তা-ই সৌন্দর্য। কিন্তু ব্র্র্যান্ডিংয়ের জন্য আমাদেরকে মেজর কনসার্নগুলো সিলেক্ট করতে হবে। সিডিএ হচ্ছে স্পাইন অব দ্য সিটি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরাও কিছু অবকাঠামো করেছি, যেগুলোর অনেক সমালোচনা আছে। তবে আমরা প্রতিদিন যে রাস্তাটা দেখছি, সেটা যেন দৃষ্টিকটু না হয়।

 

তিনি বলেন, বিপ্লব উদ্যানে ৪০ শতাংশ স্ট্রাকচার করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী বাউন্ডারি ওয়াল করলেও সিডিএ থেকে অনুমতি নিতে হবে। এত বড় একটা উদ্যানে ৪০ শতাংশ স্ট্রাকচার হয়েছে, কিন্তু সিডিএ’র অনুমতি নেয়নি। তার মানে আমি পাস কেটে গেলাম। সৌন্দর্যবর্ধন করার সিস্টেমটা হয়তো সিডিএ’র হাতে। কিন্তু আসলে ফাইনাল কাজটা কে করবে?

 

দৈনিক পূর্বকোণের প্রধান প্রতিবেদক সাইফুল আলম বলেন, সরকারি সেবা সংস্থায় কেউ দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু পরিকল্পনা করেন, সে অনুযায়ী কাজ শুরু করেন। কিন্তু তিনি বদলি হয়ে অন্য কেউ এলে কাজগুলো আর হয় না। ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যায়। আমি মনে করি চসিক বা সিডিএকে শহরের সৌন্দর্যবর্ধনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে।

 

সমাপনী বক্তব্যে দৈনিক পূর্বকোণের সিটি এডিটর নওশের আলী খান বলেন, পরিকল্পিত চট্টগ্রাম নগরী গড়তে আমাদের ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে- আমরা সবাই যার যার জায়গায় নিজেকে সবচেয়ে বড় মনে করি। পূর্বকোণ চায় সবার মধ্যে সমন্বয় থাকুক। পূর্বকোণের পক্ষ থেকে আমরা এ বিষয়ে আগেও উদ্যোগ নিয়েছি, ভবিষ্যতেও এটি অব্যাহত রাখতে চাই।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট