[হুসাম জোমলট গত ১০ নভেম্বর, ২০২৩-এ বিখ্যাত মার্কিন টিভি প্রোগ্রাম ফ্রন্টলাইন-এ দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের দ্বন্দ্বের খুঁটিনাটি নিয়ে। ‘সময়ের দাবি’ বিবেচনায় তথ্যবহুল এ সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশ দৈনিক পূর্বকোণের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হচ্ছে (প্রশ্ন ও উত্তর আকারে)। আজ দ্বিতীয় পর্ব।]
জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর সম্পর্কে আপনি আগেভাগেই ধারণা পেয়েছিলেন। কী মনে হয় আপনার এ ব্যাপারে? ফিলিস্তিন (বিশেষত পিএলও) কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর অবস্থা কেমন বুঝেছিলেন যখন দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়?
মনে হয়েছে মার্কিন প্রশাসন নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার অংশ হয়ে উঠেছিল। গত ৩০ বছর ধরে শান্তি প্রক্রিয়ার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানে যে, এক্ষেত্রে জেরুজালেম সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইস্যু। বছরের পর বছর ধরে তারা এটি বুঝেছে যে, জেরুজালেম তাদের ‘একটি চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছানোর’ প্রতিটি প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করেছে কারণ ফিলিস্তিনি পক্ষ পূর্ব জেরুজালেমের চেয়ে অন্য কিছুকে রাজধানী হিসেবে মেনে নেবে না। আপনি দেখতে পাবেন যে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ‘পূর্ব জেরুজালেমকে সম্পূর্ণরূপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি’ এমন চুক্তিগুলি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইসরায়েল বরাবরই জেরুজালেমকে তার কুক্ষিগত করে রাখতে চেয়েছে। মুখে প্রকাশ্যে কখনো স্বীকার না করলেও নিজেরা যে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে আগ্রহী নয় ইসরায়েল ও তার দোসরদের এহেন কর্মকাণ্ডই তার প্রমাণ।
এটিকে (জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর) ‘হৃদয় বিদীর্ণকর’ কিংবা ‘মুখে চড়’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আপনি কীভাবে একে বর্ণনা করবেন?
আমার মতে এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দু’টি উদ্দেশ্য ছিল- এক, ইসরায়েলকে আশ্বস্ত করা যে, জেরুজালেম তারই নিয়ন্ত্রণে থাকছে, এবং দুই, ফিলিস্তিনি জনগণকে জানানো যে তাদের আলোচনায় আরো নমনীয় হতে হবে, অর্থাৎ জেরুজালেমকে ভবিষ্যৎ কোনোও আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করবে না। দেখে মনে হয়, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে, নতুবা তারা সবকিছুই জানে, বোঝে- কেবল আমাদের কোনো ‘সম্ভাবনার’ দ্বার বন্ধ করতে চায়। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। সত্যিই ব্যর্থ হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের সাহায্যও বাদ দিয়েছে, বিশেষ করে গাজায় সহায়তাকারী জাতিসংঘের কিছু সংস্থাকে প্রথমবারের মতো সাহায্য দেয়া বাদ দিয়েছে। আপনি এ সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন?
হ্যাঁ, সাহায্য বাদ দেওয়া সেই কৌশলের অংশ- ফিলিস্তিনিদের ভয় দেখানো, ফিলিস্তিনিদের বশ্যতা স্বীকার করানের জন্য চাপ দেওয়ার সেই কৌশল। এটা কোনো শান্তি পরিকল্পনা ছিল না। এটা ছিল ‘আত্মসমর্পণে’বাধ্য করার পরিকল্পনা। ফিলিস্তিনিদের সম্মিলিতভাবে ‘ক্ষুধা’র স্বাদ দেবার জন্য প্রতিবছর ‘আন-র’-কে, (ইউএনআরডবিøউএ-ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ এন্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস ইন দ্য নিয়ার ইস্ট) দেয়া ৩৬০ মিলিয়ন ডলার অর্থের বড় অংশে কোপ বসানো হয়েছে। অথচ ‘আন-র’ কেবলি একটা ফিলিস্তিনি ইস্যু নয়, এটা হল ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের প্রতি জাতিসংঘের একটি দায়িত্ব। আসলে ট্রাম্প তার চার বছর ধরে নেতানিয়াহুকে এটি করতে পুরোপুরি সহায়তা করেছিলেন ফিলিস্তিন ইস্যুকে বাইপাস করার চেষ্টা করে, আরব সরকারগুলিকে, বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চলে, ইসরায়েলের সাথে শান্তি অর্জনের জন্য চাপ প্রয়োগ করে। অর্থাৎ ট্রাম্পের বরাবর চেষ্টা ছিল ফিলিস্তিনিদের ছাড়াই শান্তি অর্জন করা। যেটা ছিল অসম্ভব।
এই নীতির তাৎপর্যের পরিপ্রেক্ষিতে এবং আপনি ওয়াশিংটনে থেকে যা অনুভব করেছেন, কী মনে হয়, আপনার এটি কি সংঘাতের পথ প্রশস্ত করেছিল?
বলা যায়..। ট্রাম্পযুগ ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য একটি খুব কঠিন সময় ছিল, খুব কঠিন। দেখুন আমাদের যুবকরা এখন আমেরিকার অধ্যাপক, হার্ভার্ড এবং সর্বত্র, আমাদের ডাক্তার, আমাদের আইনজীবী। আমরা আমাদের দেশ গড়ব। আমাদের প্রথমে একটি দেশ দরকার। কিন্তু কোথায় সেটা? যেটা আছে.. সেটা আমাদের দখলে নেই। চারদিকে কেবলি আশাহীনতা। এবং আপনি কি জানেন, আশাহীনতা একটি খুব বিপজ্জনক অনুভূতি?.. খুবই বিপজ্জনক। এবং যখন হতাশা কয়েক দশক ধরে জমা হয়, তখন এটি আর কেবল বিপজ্জনক নয়; এটা সর্বনাশা। এবং আমি মনে করি যে, ট্রাম্প প্রশাসনের সময়কাল ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য কেবল ক্ষতিই বয়ে এনেছে।
আপনার অবর্তমানে ঘোষিত হয়েছিল একটা চুক্তি- কেউ কেউ একে ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ বলে অভিহিত করেছেন। হোয়াইট হাউসের লনে বিবি নেতানিয়াহু আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন বললেন, ‘আমাদের শান্তির পরিকল্পনা আছে’ তখন এর প্রতিক্রিয়াটা কেমন ছিল?
নেতানিয়াহু বলেন আর ট্রাম্পই বলেন- তাদের মুখ তো আসলে একটাই। তাদের দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে যাবার কথা ছিল। তাদের ফিলিস্তিনি ইস্যু এবং আরবদের সাথে সম্পর্ক নমনীয় করায় সরল উপায় অবলম্বন করার কথা ছিল। অথচ তারা এমন কিছু উপস্থাপন করতে চলেছিল যা বসতিসহ দখলকৃত অঞ্চলগুলিতে ইসরায়েলের অবৈধ উপস্থিতি বজায় রাখবে। এবং এটি অর্থ দিয়ে ফিলিস্তিনিদের অধিকার কেনার মতো অভব্য আচরণের মধ্য দিয়ে। এটি ফিলিস্তিনির হৃদয়ে আঘাত করেছে। যারা ১০০ বছর ধরে সংগ্রাম করে আসছে, যারা ১৯৪৮ সালের নাকবা, ইসরায়েলের বিপর্যয়, জাতিগত নির্মূল (জাতির দুই-তৃতীয়াংশ নির্মূল) মোকাবিলা করেছে। তারও পর রয়েছে- ১৯৬৭ সালের সামরিক দখল, ইন্তিফাদা এবং বিপ্লবের মতো বিশাল ব্যাপারগুলো। এতোগুলো ‘আত্মত্যাগকে একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আর একজন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী যখন টাকা দিয়ে কিনে নিতে চান, তখন স্বাভাবিকভাবেই ফিলিস্তিনজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভের উত্থান হয়। ইসরায়েল অনেক ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীকে হত্যা করেছিল। এটি একটি খুব, খুব কঠিন মুহূর্ত ছিল। ট্রাম্প এবং তার দলকে অবশ্যই একদিন ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে স্বীকার করতে হবে এবং ক্ষমা চাইতে হবে যে, তারা যা করেছে তা ছিল শুধুই নিষ্ঠুর আচরণ।
এবার আসি বহুলচর্চিত ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এ। এটি সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।
আমি সত্যিই হতবাক হয়েছিলাম। এবং আমাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, আমি এটা আশা করিনি। আমরা জানতাম যে কয়েকবার আরব-উপসাগরীয় দেশ, বিশেষ করে আমিরাত এবং বাহরাইন সফর করেছেন কুশনার। আমরা জানতাম যে তিনি এর জন্য পরিকল্পনা করছেন, এটির জন্য চাপ দিচ্ছেন। কিন্তু আমরা আশা করিনি যে এটি এত তাড়াতাড়ি ঘটবে। এটি একটি খুব কঠিন মুহূর্ত ছিল। এই কারণে নয় যে আমরা আমিরাত বা বাহরাইন এবং ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি দেখতে চাই না। প্রকৃতপক্ষে, আমরাই আরব শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব করার জন্য সৌদিদের সাথে সমন্বয় করেছিলাম। আমরা ইসরায়েল এবং সমগ্র আরব বিশ্বের মধ্যে শান্তি দেখতে চেয়েছিলাম- শুধু তাই নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বের মধ্যে। আমরা ৫৭টি দেশসহ সমগ্র ইসলামিক বিশ্বে ইসরায়েলকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এবং স্বাভাবিক করতে দেখতে চেয়েছিলাম এবং সেই কারণেই আমরা আরব শান্তি উদ্যোগ পেয়েছি।
অথচ দেখুন, তথাকথিত ওই আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পর থেকে ইসরায়েল আসলে জেরুজালেমে এবং আল-আকসা মসজিদে উস্কানি, অবৈধ বসতি নির্মাণ, অধিকৃত ভূখন্ডের ক্রমাগত সংযুক্তিকরণ, গাজা অবরোধ বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ করেছে। তাই এই চুক্তিগুলো কোনো সাহায্য করেনি, কোনোভাবেই সাহায্য করেনি বা শান্তি আনতে পারেনি, না ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের জন্য বা এই অঞ্চলের জন্য।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আরব দেশের যেকোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বরাবর ফিলিস্তিন ইস্যু প্রায়োরিটি পেয়ে এসেছে। কুশনার গং ক্রমাগত চেষ্টা করে গেছে দু’-একটি আরব রাষ্ট্রকে নানা সুবিধাদি দিয়ে ওই ধারণাটি ভেঙে দিতে। দুঃখজনকভাবে আরব আমিরাত, বাহরাইনের মতো কিছু আরব দেশ ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের তালে পড়ে ‘আরব ঐক্যমত্য’ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তারা শান্তির বিনিময়ে ‘ইসরায়েলকে আরব ভূমির দখল ছেড়ে দিতে হবে’- মুসলিম জাহানের এ আকাক্সক্ষা (আসলে দাবি) থেকেও দৃশ্যত: সরে গেছে। (চলবে)
লেখক পরিচিতি
[হুসাম জোমলট বর্তমানে যুক্তরাজ্যে ফিলিস্তিনি মিশনের প্রধান। তিনি এর আগে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের স্ট্রাটেজিক এডভাইজার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জাতিসংঘে একজন অর্থনীতিবিদ এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অর্থনৈতিক গবেষক হিসেবেও কাজ করেছেন।]