মিশরের সিনাই উপদ্বীপে তুরে সিনার অবস্থান। এই সিনাই উপদ্বীপে তুরে সিনাকেন্দ্রীক হযরত মুসা (আ.) জীবনের বড় অংশ অতিবাহিত করেন।
পবিত্র কুরআন মাজীদে ত্বীন নামে একটি সূরা রয়েছে। এই সূরাতে ওয়া তূরি ছীনিন একটি আয়াত রয়েছে। যার অর্থ বুঝায় সিনাই প্রান্তরস্থ তূর পর্বত। এখানে পরবর্তী আয়াতে ওয়া হা-যাল বালাদিল আমিন। এই নিরাপদ নগরীর।
হযরত মুসা (আ.) ফেরাউনের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে তাঁর উম্মতগণকে নিয়ে সিনাই উপদ্বীপের দিকে চলে আসেন। এখানে বাহরে কুলজুম নামক উপসাগরে তাঁর অন্যতম মোজাজা (আসা) লাঠির আঘাত করলে পানি সরে গিয়ে রাস্তা হয়ে যায়। এই রাস্তা দিয়ে মুসা (আ.) সিনাই উপদ্বীপে তাঁর উম্মতগণকে নিয়ে যান। কুখ্যাত ফেরাউন তা জানতে পেরে সৈন্যসামন্ত নিয়ে মুসা (আ.)কে আক্রমণ করতে পেছনে পেছনে ছুটে আসছিল। এসে এই বাহরে কুলজুমে মুসা (আ.)’র মুজেজায় রাস্তা দেখে বাহরে কুলজুমে ঢুকে পড়েন। হযরত মুসা (আ.)’র উম্মতগণকে নিয়ে সিনাই উপদ্বীপে উঠে গেলে রাস্তা বিলীন হয়ে পুনঃসাগর হয়ে যায়। এতে ফেরাউন তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে সলীলসমাধি হয়। কুখ্যাত ফেরাউনের মরদেহ কায়রোস্থ মিশরের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। মুসা (আ.) সিনাই উপদ্বীপে তুরে সিনা তথা সিনাই প্রান্তরে অবস্থান নেন। জীবনের বড় অংশ এখানে অতিবাহিত করেন। শেষবয়সে মূল ফিলিস্তিনে চলে গেলে জেরুজালেম থেকে ২০/২৫ কি.মি দূরত্বে পাহাড়ি এরিয়ায় ইন্তেকাল করেন।
হযরত মুসা (আ.)’র ব্যাপারে কোরআন মাজীদে অনেক অনেক বর্ণনা রয়েছে। তাঁর জীবনসঙ্গী আসা (লাঠি) ইস্তাম্বুলের তোপকাপি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। প্রায় ৬০ হাজার বর্গ কি.মি এরিয়া নিয়ে বিশাল সিনাই উপদ্বীপ। এখানে রয়েছে সিনাই পর্বত। যার উচ্চতা ২২৮৫ মিটার তথা ৭৫০০ ফুট প্রায়। যা মিশরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত। ১৯৬৭ সালে জবরদখলী ইসরাইল মাত্র ৬ দিনের যুদ্ধে পার্শ্ববর্তী তিনটি আরব দেশকে পরাজিত করে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিনিয়ে নেয়। তৎমধ্যে মিশরের সিনাই উপদ্বীপ, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং বায়তুল মোকাদ্দাসসহ জর্ডানের পূর্ব জেরুজালেম।
সিনাই উপদ্বীপ এবং মিশরের মূল ভূ-খন্ডের মধ্যখানে সুয়েজ খাল। যা লোহিত সাগর হয়ে বাহরে কুলজুম অতিক্রম করে এই সুয়েজ খাল দিয়ে ভূমধ্যসাগরে পতিত হয়। ১৯৭৩ সালে মিশরের সাহসী জেনারেল আনোয়ার সাদাত জবরদখলী ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। ১৭ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের অবস্থা অনেকটা নাজুক হয়ে পড়ে। আমেরিকার আশ্বাসে হস্তক্ষেপে মিশরকে যুদ্ধ বন্ধ করতে হয়। ক্যাম ডেভিট চুক্তির মাধ্যমে ১৯৮২ সালে জবরদখলী ইসরাইল সিনাই উপদ্বীপ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। মুল মিশর আফ্রিকা মহাদেশের অন্তভুর্ক্ত, কিন্তু সিনাই উপদ্বীপ এশিয়া মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত। জবরদখলী ইসরাইল কোন সময় কি ঘটায় সেই চিন্তায় মিশর সিনাই উপদ্বীপ নিয়ে সব সময় সজাগ। অপরদিকে মিশরীয় জনগণ সিনাই উপদ্বীপে ব্যাপক বসতি স্থাপনে তেমন আগ্রহশীল নয়। প্রায় ৬০ হাজার বর্গ কি.মি পাহাড়-পর্বত নিয়ে বিশাল এরিয়া। যা অনেকটা পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বি ত্রিভুজ আকৃতির।
হযরত মুসা (আ.) মিশরের মূল ভূখন্ড থেকে বাহারে কুলজম দিয়ে সিনাই উপদ্বীপে চলে আসেন। তিনি তুরে সিনা তথা সিনাই প্রান্তরে অবস্থান নেন। যা তুর পর্বতের অনেকটা দক্ষিণ দিকে বলা যাবে। সিনাই উপদ্বীপের এ তুর পর্বত এলাকায় হযরত মুসা (আ.) তাঁর উম্মতগণকে নিয়ে নানান ঘটনা প্রবাহ রয়েছে। ক্যাম ডেভিট চুক্তির মাধ্যমে মিশর সিনাই উপদ্বীপ ফিরে পাওয়ার পর পর্যায়ক্রমে ট্যুরিস্টদের যাতায়াতের সুযোগ করে দেয় নানান বিধি নিষেধের মাধ্যমে। অপরদিকে লোহিত সাগরের উত্তর প্রান্তে তিন উপসাগরের মোহনায় সিনাই উপদ্বীপের একদম দক্ষিণ প্রান্তে মিশরের পর্যটনশহর শারম আল শায়খ। ইহা একটি মিশরের পর্যটন শহর হিসেবে খ্যাত। নামি দামি অসংখ্য হোটেল রেস্টুরেন্টে ভরপুর। মূল মিশর থেকে এই শারম আল শায়খে আসতে হলে সিনাই উপদ্বীপে নানান বিধি নিষেধ মেনে আসতে হবে। যারা তুরে সিনার পবিত্রতম এলাকায় আসতে চায়, তারা এখানে এসে হেঁটে পাহাড়-পর্বতের উপরে উঠে।
মুসা (আ.)’র নানা স্মৃতি বিজড়িত স্থান প্রত্যক্ষ করে আবার ফিরে যায়। হযরত হারুন (আ.)’র কবরও এখানে বলে এক বর্ণনায় জানা যায়। যদিওবা এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। বাহরে কুলজুমসহ ১২৫ কি.মি দীর্ঘ সুয়েজ খাল সিনাই উপদ্বীপ মিশরের মূল খন্ড থেকে আলাদা করে রেখেছে। সিনাই নামটি প্রাচীন চাঁদ-ঈশ্বর সিন বা হিব্রু শব্দ সেনে থেকে উদ্ভূত হয়েছে। উপদ্বীপের নাম সিনাই হওয়ার আর এক কারণ হল সেন্ট ক্যাথরিনের মঠের কাছাকাছি একটি পর্বত বাইবেলে মাউন্ট সিনাই হিসাবে উল্লেখিত। তবে এই অনুমানে বিতর্ক রয়েছে। উপদ্বীপের আনুষ্ঠানিক নামটি ছাড়াও, মিশরীয়রাও এটির উল-উলুজে (ফিরোজ জমির জমি) হিসাবে উল্লেখ করে। প্রাচীন মিশরীয়রা এই উপদ্বীপকে মফেকট বা ফিরোজ ভূমি বলে উল্লেখ করেছে।
সিনাই উপদ্বীপে গমন: ১৯৯৭ সালে সপ্তাহখানেকের জন্য মিশরে অবস্থানকালে সিনাই উপদ্বীপে আসা হয়নি। গত বছর (২০২৩) আগস্টে ১৩ দিন মিশর সফরের প্রোগ্রামে কায়রো থেকে সড়কপথে তুরে সিনা আসা এবং তুরে সিনা থেকে বিকেলে শারম আল শায়খে প্রোগ্রাম করা আছে। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের হাটহাজারী ফতেয়াবাদের জাহেদ ৩ দিন আগে আমাদের পক্ষে একটি গাড়ি রিজার্ভ করেছিল বাহানাসা যাওয়া-আসা সারা দিনের জন্য। আমাদের পক্ষে এই গাড়িটি আবারও রিজার্ভ করে কায়রো থেকে তুরে সিনা হয়ে বিকেলে শারম আল শায়খ পৌঁছিয়ে দিবে। এডভোকেট মুহাম্মদ ইলিয়াস, এমদাদ উল্লাহ, নুরুল ইসলামসহ আমরা ৪ জন, জাহেদ ও বাঁশখালীর মিশকাত আমাদেরকে সঙ্গ দিল।
১২/১৪ জনের গাড়ি আমরা যাত্রী ৬ জন। ৫ রাত অবস্থানের পর ২২ আগস্ট কায়রো এ হোটেল ছেড়ে দিয়ে আমরা প্রায় ১ শত মিটার দূরত্বে ঐতিহাসিক ইসমাইলিরার দিকে এগুতে থাকি। এখানে সুয়েজখালে টানেল দিয়ে গাড়ি সিনাই উপদ্বীপে আসে। যা অনেকটা দক্ষিণ সিনাই উপদ্বীপ। বড় বড় শীপ চলাচল করে বিধায় সুয়েজ খালে কোন ব্রিজ নেই। আমরা কড়া চেকপোস্টের মুখোমুখি হই। লাগেজসহ আমাদেরকে নেমে যেতে হল, বড় বড় ট্রের উপর লাগেজ রাখতে হল, লাগেজ চেক করল, যাত্রীদের চেক করল, মেশিন দিয়ে গাড়ি পরীক্ষা করল। প্রায় ৩০/৪০ মিটার যাওয়ার পর আমাদের পাসপোর্ট চেক করল, আমাদের উপর ভালভাবে নজর করল।
আমরা ৬ জন বাংলাদেশী তুরে সিনা উপদ্বীপে যাচ্ছি তা বিভিন্ন চেকপোস্টে জানিয়ে দিল। অতঃপর আমরা টানেল দিয়ে সিনাই উপদ্বীপে প্রবেশ করে দক্ষিণ পূর্ব কোণাকোনি তুরে সিনার দিকে যেতে থাকি। মনে হল এক দেশ থেকে আরেক দেশে আসলাম। এখানে অনেকটা জনমানব শূণ্য বলা যায়। ইসমাইলিয়া থেকে ৪০ কি.মি দূরত্বে হযরত মুসা (আ.) মিশরের মূল ভূখন্ড থেকে সিনাই উপদ্বীপে যেখানে উঠেছিল তা চিহ্নিত করা আছে। কিন্তু ড্রাইভার ও ছাত্ররা এখানে থামতে অনীহা প্রকাশ করে। কেন জানি এখানে আতংঙ্ক ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। কায়রো থেকে শারম আল শায়খ এর দূরত্ব প্রায় ৫ শত কি.মি। কায়রো থেকে তুরে সিনার দূরত্ব প্রায় ৪ শত কি.মি।
মিশর সরকার অতীব গুরুত্ব দিয়ে পাশাপাশি দু’টি রাস্তা নির্মাণ করেছে একটি যাওয়ার আরেকটি আসার। অনেকটা ৩ লেইন বলা যাবে। রাস্তা অনুপাতে গাড়ি চলাচল কম। মিশরীয় ড্রাইভার কি মনে করল আমাদেরকে মূল তুরে সিনা না নিয়ে, নিয়ে গেল মুসা (আ.)’র গোসলখানায় পাহাড়ের নিচে পাদদেশে। এমনিতে আমরা ৪ জনের পক্ষে এই বৃদ্ধ বয়সে তুরে সিনায় উঠা সম্ভবপর নয়। দক্ষিণ সিনাই উপদ্বীপের মূল মহাসড়ক থেকে প্রায় এক দেড় কি.মি ভিতরে ১০/১২ ফুট প্রস্থের সুন্দর সড়ক হযরত মুসা (আ.)’র হাম্মামখানা তথা গোসলখানা পর্যন্ত ভ্রমণকারীরা যাতে আসতে পারে।
গাড়ির চালক আমাদের সরাসরি এখানে নিয়ে আসেন। অবশ্য মূল তুরে সিনার পাহাড়-পর্বতের নিচে পৌঁছতে পারলেও আমাদের পক্ষে উপরে উঠা সম্ভব হবে না। অবশ্য দক্ষিণ সিনাই উপদ্বীপের এই দিকে আরও দুয়েক জায়গায় থেমে ছিলাম। তৎমধ্যে এক রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাওয়া হয়। আমাদের বহনকারী ছোট মিনিবাস যখন শারম আল শায়খের হোটেলে নামিয়ে দেয় তখন অনেকটা বিকেল প্রায়। আমরা শারম আল শায়খে ২ রাত অবস্থান করে ২৪ তারিখ দুপুরে ইজিপ্ট এয়ারে আলেকজান্দ্রিয়া গমন করি।
লেখক: আহমদুল ইসলাম চৌধুরী, প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।
পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ