কয়েক মাস ধরে অস্থিরতা বিরাজ করছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রশাসনের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব ও উপাচার্য পদ পাওয়ার লড়াইয়ের কারণেই পরিস্থিতি টালমাটাল হয়ে উঠেছে। এতে আবারো ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপাচার্যকে ঘিরেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রশাসনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষক সমিতি। তবে উপাচার্যের অনুসারী শিক্ষকরা বলছেন, উপাচার্য পদসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে যেতে শিক্ষকদের একটি গ্রুপ পাঁয়তারা করছে। যদিও উপাচার্য বিরোধী শিক্ষকদের দাবি, ক্ষমতায় যেতে নয়, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতেই উপাচার্যবিরোধী কর্মসূচি পালন করছেন তারা।
২০১৯ সালের ১৩ জুন থেকে প্রোভিসি পদে থাকা বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শিরীণ আখতার রুটিন দায়িত্ব পালন করছিলেন ভিসি হিসেবে। এরপর একই বছরের ৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। গত বছরের ৩ নভেম্বর চার বছর মেয়াদ পূর্ণ করেছেন তিনি। এরমধ্যে প্রশাসনের নানা অনিয়মে বারবারই সংবাদের শিরোনাম হয়েছে উচ্চশিক্ষালয়টি।
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হক বলেন, প্রশাসনের কর্মকা- এক করলে বোঝা যায়, এ প্রশাসন চরম পর্যায়ের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে এনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে প্রশাসনের পরিবর্তন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
তবে প্রশাসনপন্থী শিক্ষক ও শিক্ষক সমিতির সদস্য অধ্যাপক ড. রকিবা নবী বলেন, বৃহত্তর শিক্ষকদের স্বার্থ দেখছেন না শিক্ষকদের একটি গ্রুপ। নিজের স্বার্থে ও নির্দিষ্ট এজেন্ডায় ওনারা ভিসি, প্রোভিসির পদত্যাগ চাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন।
শিক্ষক সমিতি ও উপাচার্যের দ্বন্দ্ব চরমে : শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হক নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। প্রথম থেকে উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে বিবৃতি প্রদান করে আসছে সংগঠনটির বেশিরভাগ নেতা। সর্বশেষ পরিকল্পনা কমিটির আপত্তির মুখেই গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর আইন বিভাগ ও ১৮ ডিসেম্বর বাংলা বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের বোর্ড ডাকে প্রশাসন। এ সময় বোর্ড বাতিলের দাবিতে উপাচার্য কার্যালয়ে অবস্থান করে কোনও সুরাহা না হলে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষক সমিতি।
প্রশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষক সমিতির যত অভিযোগ : গত একমাস উপাচার্য পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে শিক্ষক সমিতি। এ সময় প্রশাসনিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার নানা অভিযোগ তুলে ধরেন তারা। এরমধ্যে রয়েছে- বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটির সুপারিশ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ, বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে অতিরিক্ত নিয়োগ, প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড গঠন, তথ্য জালিয়াতির মত অভিযোগে প্রার্থীকে নিয়োগ দানের জন্য সুপারিশ, বাণিজ্য অনুষদের নির্বাচিত ডিনের সাথে উপাচার্যের অসৌজন্যমূলক আচরণ, বিভিন্ন বিভাগে বছরের পর বছর কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ রেখে শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যাহত করার অপচেষ্টা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিতর্কিত ব্যক্তিদের দিয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ বোর্ড গঠন।
বিতর্কিত নিয়োগে অস্থিরতা : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান উপাচার্যের সময়ে প্রায় দুই বছরে শিক্ষক ও কর্মচারী পদে প্রায় ২০০ জনের নিয়োগ হয়েছে। এসব নিয়োগে প্রতিবারই ‘বিতর্কের’ সৃষ্টি হয়। কারণ, বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে দেওয়া হয়েছে একাধিক নিয়োগ। বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়াও নিয়োগ পেয়েছেন ২৭ জন। এমনকি নিয়োগ বাণিজ্যের ফোনালাপ ফাঁসেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব ফোনালাপ ছিল উপাচার্য শিরীণ আখতারের ব্যক্তিগত সহকারী খালেদ মিছবাহুল ও হিসাব নিয়ামক দপ্তরের কর্মচারী আহমদ হোসেনের সঙ্গে দুজন নিয়োগপ্রার্থীর।
সিন্ডিকেট সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বিব্রত আমরা। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান তিনজন ভিসি, প্রোভিসি ও রেজিস্ট্রার অবসরপ্রাপ্ত। ওনারা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না। ইচ্ছেমতো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কে এম নুর আহমদ বলেন, আইন মোতাবেক শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে। কোথাও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি।
শিক্ষক সমিতিকে বসার আহ্বান, প্রত্যাখান নেতাদের : বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে শিক্ষক সমিতিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছিলেন উপাচার্য। কিন্তু সমিতির নেতারা তা প্রত্যাখান করেন। উপাচার্যপন্থী শিক্ষক ও সমিতির সদস্য অধ্যাপক ড. রকিবা নবী বলেন, উপাচার্য শিক্ষক সমিতির সভাপতি, সেক্রেটারি মহোদয়কে আলোচনা করার জন্য বারংবার ডেকেছেন। তারা কর্ণপাত করেনি। শিক্ষক সমিতির অনেক দাবি বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। বাকিগুলোও হওয়ার পথে। তবুও তারা ভিত্তিহীন আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তবে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী বলেন, আগে একবার চায়ের দাওয়াতে গিয়ে অপমানিত হয়েছি। উনি (উপাচার্য) যে আচরণ করেছে, তা একজন শিক্ষক হিসেবে আমি বিব্রত। এর পুনরাবৃত্তি আর চাই না।
একদিনে খরচ ৬৭ লাখ : ২০২৩ সালের ৪ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস এন্ড ফিশারিজ অনুষদের একাডেমিক ভবন উদ্বোধনে তিন খাতে সাড়ে ৬৭ লাখ টাকা খরচ দেখিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে এই অস্বাভাবিক খরচ নিয়ে এখনও ক্যাম্পাস জুড়ে চলছে নানা সমালোচনা।
তিন খাতের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস এন্ড ফিশারিজ অনুষদের একাডেমিক ভবন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৪৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, ‘বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ভিসি কার্যালয়ে নতুন এক সেট সোফা (শিক্ষামন্ত্রীর বসার জন্য) ক্রয়ে ৪ লাখ ৪৫ হাজার ১৫৯ টাকা। এরমধ্যে বড় দুটি খরচের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নুরুল আজিম সিকদার।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী বলেন, যেখানে অর্থসংকটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পাঠদান, গবেষণা ও শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, সেখানে এসব অস্বাভাবিক খরচ খুবই দুঃখজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে এসব বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কে এম নুর আহমদ বলেন, ব্যয়ের হিসাব স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। অবান্তর কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি।
উপাচার্যের বক্তব্য : উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার বলেন, সম্প্রতি শিক্ষক সমিতি কিছু দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে। তারা প্রশাসনের কাছে ২৬টি দাবি জানিয়েছেন। আমরা ইতোমধ্যে ২০টির বেশি বাস্তবায়ন করেছি। বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যারা আন্দোলন করছে তাদের সকলের পদোন্নতির বোর্ডও যথাসময়ে আমি নিশ্চিত করেছি। সম্প্রতি শিক্ষক সমিতি বাংলা এবং আইন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ না দিতে দাবি জানিয়েছেন। আমরা ইতোমধ্যে বাংলা বিভাগের বোর্ড স্থগিত করেছি এবং আইন বিভাগেও যদি শিক্ষক সমিতি না চাই তাহলে বোর্ড প্রয়োজনে স্থগিত রাখা হবে। শিক্ষক সমিতির সুনির্দিষ্ট নানা দাবি থাকতে পারে। কিন্তু ভিসি-প্রোভিসিকে পদত্যাগ করানো তাদের দায়িত্ব না।
পূর্বকোণ/পিআর