ষষ্ট বারের মতো সরকার গঠন করলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চম বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যুগ করলেন। তাঁকে অভিনন্দন।
দেড় দশকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ আজ অপ্রতিরোধ্য। পনর বছরের পথচলার আজকের আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ। একটি সরকারের সফলতা যেমন থাকে, ব্যর্থতাও তেমন থাকে। ক্ষমতাসীন দলের যেমন অনেক কর্মকান্ড প্রশংসিত হয়েছে, আবার তেমনি সমালোচিতও হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, দুর্নীতি, সিন্ডিকেট, ঋণ খেলাপি, অর্থ পাচার ও ডলার সংকট। নতুন মেয়াদের সরকারের অনাগত দিনগুলো সরকারের জন্য নিস্তরঙ্গ ও দুর্ভাবনাহীন নাও হতে পারে। সরকারকে নানারকম কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
দেশের অর্থনীতির ভীত তেমন মজবুত নয়। রিজার্ভ সংকট, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও ডলারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, দেশের অর্থনীতিতে বড় সংকট সৃষ্টি করেছে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার ক্রমশ অবমূল্যায়ন হচ্ছে। কোনোভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব মতে, গত দেড় বছরে ডলারের দাম ২০ শতাংশেরও অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৫.৮ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেতে পারে বলে বিশ্ব ব্যাংক জানিয়েছে। এদিকে দেশে ডলার সংকট প্রকট। সেখানেও করাল থাবা মেরেছে সিন্ডিকেটচক্র। নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে দেশ গভীর সংকটে নিপতিত হবে। ব্যাংক খাতে এখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এখানে ব্যাপক অনিয়ম, নৈরাজ্য, অব্যবস্থাপনা বেড়েছে অনেকগুণ।
ব্যাংক খাতের অনিয়ম ব্যাপক সমালোচিত হওয়ায় সরকারের সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে। অধিকাংশ ব্যাংকেই অভ্যন্তরীণ সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপির সংখ্যা ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংক খাতে নৈরাজ্য ও খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি গ্রাহকদের আস্থা কমে যাচ্ছে। পর্বতসম ঋণ আদায়ে শ্লথগতি আর লুটেরার দল লুটেপুটে শেয়ারবাজারে কবরের নিস্তব্ধতা এনে দিয়েছে। পুজিবাজার মৃতপ্রায় পুজিবাজারকে জীবিত করা সম্ভব হয়নি। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, অনাদায়ি ঋণ আদায়ে যথাযথ আইন প্রয়োগ এবং মৃত পুঁজিবাজারকে পুনরুজ্জীবিত করে অর্থনীতি সুদৃঢ় করা সরকারের জন্য খুবই জরুরি। অন্যথায় দেশের অর্থনীতিতে এক নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
দেশের জনগোষ্ঠির বিশাল অংশ দারিদ্যসীমার নীচে বাস করে। দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে দিশেহারা সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ। যার কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। অসাধু চক্রের কারণে দেশের বাজারগুলোতে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরেও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার দফায় দফায় অস্থির। বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য হৃাস পেলেও কমছে না দেশে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট জনগণ হতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে ভূতপূর্ব বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবস্থা গ্রহণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। যার প্রেক্ষিতে সরকারের জনপ্রিয়তা হৃাস পেয়েছে।
মুনাফাভোগী, অসাধুচক্র সিন্ডিকেট সক্রিয়। বিশেষ করে রমজানকে উপলক্ষ করে দুষ্টুচক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের চাহিদা পেট পুরে দু’মুটো অন্ন। কিন্তু এখন তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাই টিসিবির মাধ্যমে পর্যাপ্ত খোলাবাজারে পণ্য বিপণন, বাজার মনিটরিং, নিশ্চিত এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ ও দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকারের সর্বোচ্চ উদ্যোগ জরুরি। আমজনতার প্রত্যাশা এ সংকট উত্তরণ ঘটিয়ে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে নতুন সরকার।
বর্তমানে অন্যতম প্রধান সমস্যা বিদেশে অর্থ পাচার। এ সমস্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের সিংহভাগ পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিছুতে রোধ করা যাচ্ছে না। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, গত ৫০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ায় দুর্নীতিবাজরা দিন দিন বেপারোয়া হয়ে উঠেছে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে কঠোর আইনের মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধে অবিলম্বে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।
দুর্নীতি দেশের উন্নয়নে বড় অন্তরায়। ক্যাসিনোকান্ডে জড়িত প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে প্রশংসা কুড়ালেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার সফলতা অর্জন করতে পারেনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি থাকলেও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি সরকার। জনগণ দুর্নীতি ও দুষ্টচক্র নিয়ন্ত্রণ চায়। দুর্নীতিবাজ ও মাদক সম্রাটদের উল্লাস আজ বড় বেশি তীব্র হয়ে উঠেছে। এদের বিভীষিকাময় উল্লাস দেখতে চায় না বাংলাদেশ। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে মাদক ও দুর্নীতি দমন হবে সরকারের বড় দায়িত্ব।
সরকার এখনো পর্যন্ত সবখাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। স্বচ্ছতা, জবাবদিহীতা, ট্রান্সপারেন্সি সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে দুদক, রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংক সহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কাঠামোগত সংস্কার এনে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। জনশক্তি রপ্তানি খাত হচ্ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত। কর্মসংস্থানের জন্য ২০২৩ সালে প্রায় ১৩ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে গমন করেছে, কিন্তু রেমিটেন্সের মাত্রা তুলনামুলকভাবে কম। প্রায় সময় অভিযোগ ওঠে তাদের জন্য সরকারি সুযোগ, সুবিধা নেই। প্রবাসী আয় দেশে প্রেরণ করতে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। প্রায় সময় শোনা যায় প্রবাসীরা বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের দেশে এসে বিমানবন্দরে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হয় এবং তাদের দেশে কোনো মর্যাদা দেয়া হয় না। সরকারের এ সমস্যাগুলো দ্রুত নিরসনে উদ্যেগী হওয়া প্রয়োজন।
দেশে যোগাযোগ খাতে নতুন ইতিহাস রচিত হয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা সফল হলেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রদানে সরকারের কিছুটা সুনাম ম্লান হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের ঈর্ষণীয় সাফল্য আসলেও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সারাদেশে বির্তক সৃষ্টি হয়েছে। ২ লাখ ১০ হাজার গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর প্রদান দারিদ্রের হার হৃাসের সুনাম কুড়ালেও স্থানীয় ভূমিদস্যুদের লাগামহীন দস্যুতার কারণে জনজীবন অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে সরকারের সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে।
দেশে প্রথমবারের মতো প্রধান নির্বাচন কমিশনারও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগে নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়ন যেমন প্রশংসিত হয়েছে পক্ষান্তরে স্থানীয় সরকারের প্রতিটি নির্বাচন বারবার বির্তকিত হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারি সংকট সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা এবং মানুষকে করোনা টিকায় আওতায় আনতে পারায় দেশবিদেশে প্রশংসিত হয়েছে সরকার, তবে ভবিষ্যতে যেকোনো মহামারি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সক্ষমতা সরকারের নেই। ‘কারো সাথে বৈরীতা নয়’- এ পররাষ্ট্রনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের সকল দেশের সাথে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করা, সড়কপথে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস, পরিবহণ সেক্টরে নৈরাজ্য বন্ধ, স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিত করা, শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে দেশের বিপুল জনসম্পদকে জনশক্তিতে রূপান্তর, পোষাকশিল্প, শ্রমবাজার সহ অন্যান্য পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ, দারিদ্র বিমোচন, আয় বৈষম্য নিরসন ও নির্বাচনী ইশতিহারে ১১টি বিষয়ে বাস্তবায়ন দেখতে চায় জনগণ।
দেশের সবচেয়ে বড়শক্তি কৃষিখাত। কৃষিতে যদি উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়, তবে শস্য আমদানি নির্ভরতা কমে যাবে। তাই কৃষিব্যবস্থা লাভজনক করার লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি কৃষিজমি আবাদের আওতায় আনার ব্যবস্থা, কৃষিতে ভর্তূকি, কৃষকদের কৃষিকাজে উৎসাহিত করা, তাদের জন্য বিশেষ সুযোগ, কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য সুনিশ্চিত করা, সুবিধা, বিনাসুদে কৃষিঋণ চালু ও সহজলভ্যতা এবং কৃষি-প্রণোদনাসহ সার, কীটনাশক ও কৃষি-সরঞ্জাম ইত্যদি সূলভে ব্যবস্থা করার সরকারের উদ্যেগ নিতে হবে।
সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। আমরা আশা করি, জনগণের প্রত্যাশা পুরণে সরকার উদ্যোাগী হবেন এবং একটি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে যাবে।
লেখক: সালাহউদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিপু, আইনজীবী।
পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ