সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশের এমন অগ্রগতি সারাবিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে। জাতি হিসেবে আমরা গর্ব অনুভব করছি।
অন্যদিকে যে বিষয়টি আমাদের সীমাহীন লজ্জায় ফেলছে, আমাদের মাথা নত করে দিচ্ছে, লাগামহীন দুর্নীতি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশে উন্নয়নের যে ধারা সূচিত হয়েছে, তার সাফল্য অনেকাংশেই ম্লান করে দিচ্ছে প্রশাসনের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে এবং দিনে দিনে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির ব্যবহার কোথায় হচ্ছে এবং কারা ভোগ করছে, তা সঠিকভাবে বণ্টন হচ্ছে কি না ইত্যাদি বিষয় জনগণের বৃহত্তর স্বার্থেই ভালোভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করলেও সমাজের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি থাকায় এর সুফল জনগণ ঠিকভাবে পাচ্ছেন না। তবে দুর্নীতি না থাকলে আমাদের দেশ অনেক আগেই মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশ হয়ে উঠত, সে কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের সবার প্রিয় এ দেশে যত সমস্যা জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতি, ন্যায়বিচার ও সুশাসনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং দাঁড়াচ্ছে, দুর্নীতি তার মধ্যে অন্যতম। জনসংখ্যাধিক্য ও ক্ষুদ্র আয়তনের এ দেশটির একদিকে যেমন বিরাজ করছে সম্পদের অভাব, তেমনি অপরদিকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিরাজ করছে দুর্নীতির কালো ছায়া। দুর্নীতি নামক সমাজের সর্বগ্রাসী এই কালোব্যাধিটি যে তার কালো থাবা বিস্তার করে সমাজকে দিনে দিনে রাঘববোয়ালের মতো গ্রাস করেই চলেছে, তা সহজেই অনুমেয়। শুধু তাই নয়, দুর্নীতি নামক এই কালোব্যাধির কারণে একদিকে যেমন জিডিপি তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি সফলতা পায়নি; তেমনি অপরদিকে জীবনযাত্রার মানও হচ্ছে নিম্নগামী।
দুর্নীতির কারণে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে, আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে নাটকীয়ভাবে। একসময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, বন ও পরিবেশ, জেলা-উপজেলা, কর্মকর্তাভিত্তিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়ক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রেই প্রতিনিয়ত দুর্নীতির মহোৎসব চলতে দেখা গেছে। তবে এ অবস্থার যে এখন উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে তা নয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি (অর্থাৎ, দুর্নীতিকারী যে-ই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে, তার কোনো ছাড় নেই) ঘোষণা করেছেন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকর থাকলে আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযান সঠিকভাবে অব্যাহত থাকলে নিশ্চয় এই দেশ থেকে দুর্নীতি নামক কালোব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। ইতঃপূর্বে আইডিবি, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও নীতিনির্ধারকরা দুর্নীতি হ্রাস করার উপায় হিসাবে অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। টিআইবিও বিভিন্ন সময়ে সভা, সেমিনার ও রিপোর্টের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধে নানাভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে কিছু সুপারিশ বর্তমান সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন- দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখানো; দুদককে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং অবাধ গণমাধ্যম ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা। তা ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে সব কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার যথাযথ ব্যবস্থা করা, দারিদ্র্য বিমোচন ও আয়বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন, দুর্নীতি দমন কমিশনকে প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং দুর্নীতি বিষয়ক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা জরুরি।
পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে তাদেরকে শুধু ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করাসহ তাদেরকে সামাজিকভাবে বর্জন করার ব্যবস্থা করা দরকার। দুর্নীতি রোধের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সংস্কার, সুশীল সমাজ গঠন, ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে দুর্নীতির প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন ও তা দূর করতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করাও আবশ্যক। এ ছাড়া গণমাধ্যমকে প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির সুযোগ করে দেওয়া, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় সম্পৃক্ততা বিচ্ছিন্ন করা এবং সর্বক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটানো জরুরি। সর্বোপরি, দুর্নীতি থেকে এ দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে সর্বত্র প্রয়োজন ‘সততা’র একটি আবহ, দরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিমণ্ডল।
এ কথা সবারই স্মরণে রাখা দরকার, এ দেশটি আমার, আপনার, সবার। ১৯৭১ সালে এক সাগর রক্ত ও লাখো মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে যেসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ দেশটির জন্ম হয়েছিল, সেসব উদ্দেশ্য সফল করার পাশাপাশি স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল পেতে হলে এবং নানা সমস্যায় জর্জরিত এ দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে বাঁচাতে হলে দেশ থেকে ‘দুর্নীতি’ নামক এই কালো, ভয়ংকর ও সর্বগ্রাসী ব্যাধিকে যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তাই আসুন, আমরা সবাই সম্মিলিত কণ্ঠে দুর্নীতিকে ‘না’ বলি, দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করি আর দুর্নীতিবাজদের কঠোর হস্তে দমন করি। আর নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করি বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসাবে তুলে ধরতে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে বর্তমান সরকারসহ সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ ও দুর্নীতি প্রতিরোধকল্পে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের সবার প্রিয় বাংলাদেশকে একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সরকারি চাকুরেদের উচ্চপদে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি প্রভৃতিতে অন্য কোনো বিষয়ে প্রাধান্য বাদ দিয়ে সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠার মূল্যায়ন করতে হবে। সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। তাদের জনগণ ও স্টেকহোল্ডারদের অভাব-অভিযোগ শুনে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হতে হবে।
চাকরির প্রথম দিকের প্রশিক্ষণগুলোতে সততা, নৈতিকতা, দেশপ্রেমের ওপর প্রাধান্য দিয়ে সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে। দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রেও সন্ত্রাসী, লোভী ও অসৎ ব্যক্তিদের বয়কট করতে হবে। দেশে লাগামহীন দুর্নীতি যেমন হয়, তার বিপরীতে সৎ, দেশপ্রেমিক ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিরাও রয়েছেন। সমাজের ও দেশের জন্য তারা উদাহরণস্বরূপ ও অনুসরণযোগ্য। দেশ এগিয়ে যাওয়ার পেছনে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। সরকারের শুভাকাক্সক্ষী ও দেশপ্রেমিক সুশীল ব্যক্তিরা নানা জায়গায় তাদের আলোচনায় উঠে আসে ‘গত ৫০ বছরে আমাদের সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো, আমরা দুর্নীতি রোধ করতে পারিনি। দুর্নীতির পরিসর বেড়েছে।
আগামীতে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো কার্যকর করে তুলতে যোগ্যদের যথাস্থানে পদায়নের বিকল্প নেই। যেকোনো মূল্যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন প্রতিহত করতে হবে। এর সঙ্গে সমাজের সর্বস্তরে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সৎ ও যোগ্যদের যথাস্থানে বসিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নিতে হবে। জনগণকেও এ ব্যাপারে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধই হোক বাংলাদেশের এক নম্বর অগ্রাধিকার। তাই এবার নতুন সরকারের শপথ হোক দুর্নীতি নামক কালোব্যাধি নিয়ন্ত্রণের।
লেখক: সুপ্রতিম বড়ুয়া, সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, রামু সরকারি কলেজ, কক্সবাজার।
পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ