পৃথিবীর সব বড় বড় শহর গড়ে উঠেছে কোন না কোন নদীর তীরে। কারণ মানবসভ্যতার ইতিহাসে যখন দ্রব্যবিনিময় প্রথম শুরু হয় তখন মানুষ সমুদ্রপথে এক দেশ থেকে অন্যদেশে যাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে সামুদ্রিক অভিযান শুরু করে। সাহসী সামুদ্রিক অভিযানের ফলে যখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার জন্য সমুদ্রপথ আবিষ্কার হয় তখন মানুষ চিন্তা করতে থাকে, নিজেদের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত পণ্য অন্য দেশে রপ্তানি করে স্বর্ণ, রৌপ্য ইত্যাদি মূল্যবান ধাতু হস্তগত করতে। এখান থেকে শুরু হয় বৈদেশিক বাণিজ্য। ফলে সমুদ্রের উপকূলবর্তী বিভিন্ন শহর যেমন গড়ে উঠেছে তেমনি গড়ে উঠেছে সামুদ্রিক বন্দর। কিন্তু সামুদ্রিক বন্দরে খালাসকৃত আমদানি পণ্য গ্রামগঞ্চে এবং দেশের ভেতর বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেবার জন্য একমাত্র উপায় ছিল নদীপথ। ফলে নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শহর ও বন্দর। এ সময়ে নদীপথই ছিল একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। এ কারণে প্রতিটি নদীর বিভিন্ন অংশে বড় বড় শহর গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের এমন একটি নদীর নাম কর্ণফুলি।
ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে পাহাড়-পর্বত ও গভীর অরণ্যে ঘেরা মিজোরাম রাজ্যের লুসাই পাহাড় থেকে কর্ণফুলির উৎপত্তি। এরপর ১৮০ কিলোমিটার পার্বত্যপথ অতিক্রম করে সেখান থেকে রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলার খিগামুখিলামায় প্রবেশ করেছে কর্ণফুলি, খিগামু থেকে বড় হরিণার মুখ পর্যন্ত এ ছয় কিলোমিটার কর্ণফুলি নদীর ডানপাশে ভারত এবং বামপাশে বাংলাদেশ। অতীতে কর্ণফুলি নদীটিকে ক্রাইজা খাল লিখা হয়েছে। মারমা অধিবাসীদের কাছে নদীটির নাম হিংসা ছিয়ং। আর মিজোরামে কর্ণফুলি নদীর নাম খাওতলাং তুইতি। প্রাচীন জনগোষ্ঠীর কাছে কর্ণফুলি নদীটি ক্রাইজা নামেও পরিচিত ছিল। কর্ণফুলি নদীর মোট দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৩২০ কি. মি.। তৎমধ্যে বাংলাদেশের অংশের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ২৭৫ কি. মিটার। আর কর্ণফুলি নদীটি পার্বত্যপথ অতিক্রম করেছে ১৮০ কি. মিটার। এতটুকু পথ অতিক্রম করে রাঙামাটিতে একটি সংকীর্ণ শাখা বিস্তার করে পরবর্তীতে আঁকা-বাঁকা গতিপথ বেয়ে ধূলিয়াছড়ি ও কাপ্তাই-এ দুইটি প্রধান শাখায় বিভক্ত হয়েছে। এরপর কর্ণফুলি নদীটি বাংলাদেশের বিভিন্ন পথ প্রান্তর অতিক্রম করে মিলিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের হরিণা থেকে আঁকা-বাঁকা গতিপথ বেয়ে ধূলিয়াছড়ি ও কাপ্তাই- এ দুইটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় অর্ধেক এলাকা জুড়ে কর্ণফুলি নদী শাখা প্রশাখা বিস্তার করে আছে। কর্ণফুলির উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত দীর্ঘ পথ জুড়ে দুই কূলে গড়ে উঠেছে নানা জনপদ ও নগর সভ্যতা। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্য সমৃদ্ধিতে চির চঞ্চলা, খরস্রোতা কর্ণফুলির ভূমিকা অপরিসীম। এ নদীর মোহনায় বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর তথা চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর অবস্থিত। কর্ণফুলি নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে রাঙামাটি জেলায় কাপ্তাই উপজেলায় ‘কাপ্তাই বাঁধ’ তৈরি করা হয় ১৯৬৪ সালে। এ বাঁধের সঞ্চিত পানি ব্যবহার করে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এ জলবিদ্যুৎ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছে প্রায় ৬০ বছর। শুধু তাই নয়, কর্ণফুলির সাথে সংযুক্ত হয়েছে অপর একটি শাখা নদী যা শুধু বাংলাদেশের ঐতিহ্য নয়, বরং বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। এ শাখা নদীর নাম হয় ‘হালদা’- নদী। চট্টগ্রামের মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলি ইউনিয়নের পাহাড়ী গ্রাম সালদা। গ্রামের পাহাড়ী ঝর্না থেকে নেমে আসা ছড়ার নাম ও সালদা। এ সালদা ছড়ার সাথে মিল রেখে হালদা নদীর নামকরণ করা হয়। বাটনাতলি পাহাড় হতে উৎপন্ন সর্পিল আকার নদীটির দৈর্ঘ্য ১০৬ কি. মি. এবং গড় প্রস্থ ১৩৪ মিটার। এটি পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী যেখানে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে আমবস্যা বা পূর্ণিমার তিথিতে। অনুকূল পরিবেশে ডিম ছাড়ে মা মাছ। ডিম ছাড়ার এ বিশেষ সময়কে স্থানীয়রা ‘জো’ বলে। ‘জো- এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আমবস্যা পূর্ণিমায় জোয়ারের পানি ফুলে যায়। সেই সাথে যদি প্রচন্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টি হয় তবে মা মাছ এ অবস্থাকে ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ বলে মনে করে। কারণ প্রচন্ড বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ী এলাকা থেকে পানির ঢল নামতে থাকে। ঢলের পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্রোত হয়ে ফেনা আকারে প্রভাবিত হয়। এ সময় পূর্ণ জোয়ার বা ভাটার শেষে পানি যখন স্থির হয় তখনই কেবল মা মাছ ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ না পেলে মা মাছ নিজের দেহের মধ্যে ডিম নষ্ট করে দেয়। মা মাছেরা ডিম ছাড়লে জেলেরা এসব ডিম সংগ্রহ করে বিভিন্ন বানিজ্যিক হ্যাচারীতে উচ্চ মূল্যে বিক্রয় করে।
হালদার সাথে বাংলাদেশের অন্যান্য নদীর যেমন- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ইত্যাদি নদীর কোন সংযোগ নেই। ফলে রুই জাতীয় মাছের ‘জীনগত মজুদ’- সম্পূর্ণ অবিকৃত রয়েছে। হালদা নদী কেবল মাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য নয়। এটি ইউনেস্কোর শর্ত অনুযায়ী বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের যোগ্যতা রাখে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কর্ণফুলি নদীর অবদান বিশ্লেষণ করা হলে, কর্ণফুলি নদীর শাখা নদী হালদা নদীর অবদান ও বিশ্লেষণ করতে হয়। বাংলাদেশের ছোট বড় প্রায় ৮০০ নদীর মধ্যে দেশের পূর্ব পাহাড়ী অঞ্চলের খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছোট্ট একটি নদী হলো হালদা নদী যা কর্নফুলি নদীর শাখা নদী হিসেবে পরিচিত। প্রকৃতির বিস্ময় দৃষ্টিকারী হালদা নদী হলো বিশ্বের একমাত্র জোয়ার ভাটার নদী। তা ছাড়া এ নদীটি এশিয়ায় একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র। কিন্তু কেন বা কী কারণে মাছ হালদায় ডিম দেয় তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ রয়েছে। রহস্যময় পৃথিবীতে হালদা নদী হয় মহারহস্যে ঘেরা এক নদী। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার বটনাতলি পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে মানিকছড়ি, চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বুড়িশ্চরের নিকট কর্ণফুলি নদীতে মিলিত হয়েছে। নদীটির প্রকৃতি স্বপ্নীল আকার। হালদা নদীতে মাছে ডিম ছাড়ার রহস্য অনেকটা পরিবেশগত। হালদা নদীর কিছু ভৌত ও জৈব রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যই এই নদীকে করেছে মাছের ডিম ছাড়ার উপযোগী। ভৌত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে এ নদীর অনেকগুলো বাঁক। এ বাঁকগুলোতে স্রোতের কারণে ঘূর্ণিয়মানতার সৃষ্টি হয়, যা নদীর গভীরতাকে সৃষ্টি করে। স্থানীয় ভাষায় এ গভীর স্থানগুলোকে কুয়া বলে। বিভিন্ন ভারী পদার্থ ভেসে এসে এই কুয়ার মধ্যে জমা হয়। ফলে পানি ঘোলাটে হয়ে যায়। মা মাছ এ কুয়ার মধ্যে আশ্রয় নেয়। তাছাড়া এক গবেষণায় দেখা যায়, হালদা নদীর গভীরতা ও গঠন এমন যে, কিছু কিছু স্থানে পানির চতুর্মুখী ও ত্রিমুখী ঘুর্ণির সৃষ্টি হয়। এগুলোকে বোটেক্স জোন বলা হয়। এ অবস্থা মা মাছকে ডিম ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এরূপ নদীর বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের আর কোনো নদীতে দেখা যায় না। মাছের ডিম ও রেণু সংগ্রহের সময় হলো বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসের আমবস্যা ও পূর্ণিমার প্রবল বর্ষণ অবস্থা। এ সময় নাজিরহাট, সাত্তার হাট, আজমির হাট, বৈতার হাট, রামদাস মুন্সির হাট ও পাশ্ববর্তী এলাকার জেলেরা মিহি মশারীর নেট দিয়ে ডিম ও রেণু সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে বিভিন্ন বানিজ্যিক হ্যাচারীতে বিক্রয় করে।
হালদা নদী হয় কর্ণফুলি নদীর একটি শাখা নদী। মা মাছ ডিম ছাড়ার জন্য কর্ণফুলি নদী অত্রিক্রম করে হালদা নদীতে প্রবেশ করে। এ নদীর সুবিধাজনক অংশে অনুকুল পরিবেশে মা মাছ ডিম ছাড়ে। এ নদী থেকে প্রাপ্ত ডিম, উৎপাদিত রেণু এবং উৎপাদিত মাছের পরিমাণ হিসাব করলে দেখা যায় এক বছরে অর্থনীতিতে হালদার অবদান প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এই অবদান কর্ণফুলি নদীর অবদান বলেও বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কর্ণফুলি নদীর অবদান হয় অপরিসীম। এ নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে, অনেক বাজার বা বিক্রয় কেন্দ্র, শিল্প, সর্বোপরি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম। কর্ণফুলি নদীর মোহনায় রয়েছে বাংরাদেশের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর, এ বন্দরের আয় এদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। সাধারণত কোন জাহাজ বন্দরে ভিরলে পোর্ট ডিউজ, রিভার ডিউজ, পাইলটের চার্চ ও অন্যান্য চার্চ সহ বন্দরের আয় হয় দৈনিক সাড়ে ছয় লাখ থেকে সাত লাখ টাকা। যদি চট্টগ্রাম বন্দরের আয় দৈনিক সাড়ে ছয় লক্ষ টাকা হিসেবে ধরা হয় তবে সেই হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের মাসিক আয় হয় ১ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা। আর প্রতি বছরে বন্দরের আয় হয় ২৩ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। চট্টগ্রাম বন্দরের এরূপ আয় বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। কর্ণফুলি নদীর উভয় তীরে গড়ে উঠেছে অনেক হাট, বাজার ও নৌবন্দর। চট্টগ্রাম শহর থেকে এসব হাট, বাজারে জনগণের নিত্য পণ্য ও অন্যান্য পণ্য আনার জন্য ব্যবহৃত হয় নৌপথ যা কর্ণফুলি নদীর ওপর দিয়ে তুলনামুলক কম খরচে পরিবহন করা হয়। এ নদীর দুই তীরে বসবাস করে অসংখ্য জেলে সম্প্রদায়। তাদের জীবিকার প্রধান উৎস হয় এ নদী। বর্তমান সময়ে এ নদীর মিঠা পানি চট্টগ্রাম ওয়াসা জোগান দিচ্ছে নগরবাসীদেরকে। সবদিক দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যায়, কর্ণফুলি নদী হয় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ যা অন্যান্য নদীর তুলনায় এদেশের অর্থনীতিকে সহায়তা করে অধিক।
লেখক: প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি।
পূর্বকোণ/জেইউ