চট্টগ্রাম সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

‘নিজেকে হারিয়ে খোঁজার মতো শাস্তি আর হয় না’

ফারজানা তাবাসসুম

২১ ডিসেম্বর, ২০২৩ | ২:২১ অপরাহ্ণ

স্বকীয়তার ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত। রোজ অল্প অল্প করে হারাতে দিলে একদিন হুট করে আয়নায় চেনা মুখ অচেনা হয়ে যায়। স্বকীয়তা বাইরে থাকে, ভেতরেও। বাইরের অংশটা হারালে আদতে তেমন কিছু এসে যায় না।

কিন্তু কি জানো? বাইরের বদলটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভেতরের বদলের প্রতিফলন হিসেবেই আসে।

যেমন ধরো, স্বকীয়তা থাকে চুলের স্টাইলে। কপালের ভাঁজে, মুচকি হাসিতে, গজ দাঁতে। স্বকীয়তা থাকে চিন্তায়, বিশ্বাসে, কথা বলার ধরণে। স্বকীয়তা বাস করে নম্রতায় বা রুঢ়তায়। তাকানোতে, হাঁটায়। স্বকীয়তাকে সবচে সহজে বোধহয় অনুভব করা যায় ভালোবাসার ধরণে।

স্বকীয়তার ওপর প্রথম আঘাতটা আসে information overload থেকে। না চাইতেও লোকে বলে দেয় কিভাবে কথা বললে, হাঁটলে, চুল কাটলে, দাঁতে ব্রেস পড়লে ট্রেন্ডি হওয়া যাবে। নরম-সরম ভালো মানুষটার কানে রোজ আসে, ‘আজকাল অত নমো নমো করা মানায় না। স্বভাবজাত যে নম্রতা ওটা তোমার সবচে বড় শত্রু। Speak up!’

অন্যায়ের প্রতিবাদ না, রোজকার জীবনেই ওকে আরও কঠিন হতে হবে! ভালোর জন্যেই বলছে লোকে। নাহলে অন্যেরা ঠিক পাত্তা দেয়না। নিজের মতো করে নিজের গল্পটা বললে কেউ শোনে না আজকাল। অনেক রঙ চড়াতে পারলে সে গল্পের বিক্রিবাট্টা হয় বেশ।

স্বকীয়তা ছুটে পালায় যখন নিজের ‘না’ কে প্রয়োজনের তাগিদে ‘আচ্ছা, ক্ষতি কি?’ তে বদলে নেয়া হয়। আসলে দেশ বদলালে বদলায় না লোকে। বদলায় যখন তার মনে হয় আজন্মের প্রিয় অভ্যাস বদলে নিতে হবে কেবল জায়গা বদলের সাথে মানিয়ে নিতে। মানিয়ে নেয়াও না আসলে। Fit in করতে।

এর ঠিক বাংলা কি হয়? উদ্দেশ্যটা সরল- লোকে যাতে প্রশ্ন তুলতে না পারে। আধুনিক হবার যেসব শর্ত আছে তার সবগুলো বেচারার পছন্দও না। তবু মেনে নেয় সে। অনুসরণ করে যায় চুপচাপ।

বদ অভ্যাসের গল্প আলাদা। দেশ বদলের সাথে চেনা বদ অভ্যাসের বদল বরং স্বকীয়তার বন্ধু। কিন্তু ও পথে লোকে হাঁটে কম। কঠিন যে! অন্যের প্রিয় হবার চেষ্টাটা বরং সহজ।

লাইক, ভিউ দিয়ে টাকা কামানো যায়। স্বকীয়তা দিয়ে কি হয়? কিছুই না। এ ভাবনায় নিজেকে বদলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কেউ কেউ একদিন টের পায় যা হারিয়েছে তার বিনিময়ে পৃথিবীর সব অর্থবিত্ত তুচ্ছ। কিন্তু এতো দূর এসে কি পেছনে ফেরা যায় আর? এ ক্লান্তি অন্য পৃথিবীর।

নিজেকে হারিয়ে খোঁজার মতো শাস্তি আর হয় না। তার চেয়েও নিষ্ঠুর সত্য হল, লোকের পছন্দ মোটেই ধ্রুব কিছু না। আজ যা ভালো লাগছে, কাল তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে ওরা।

কবার বদলাবে তুমি? তাল মেলাবে কত? দিনশেষে তোমার পুরোটা নিয়েই তো তুমি। যেভাবে কথা বলতে তোমার স্বস্তি হয়, যে ধর্ম বিশ্বাস করো তুমি, যে ঈশ্বরে ভক্তি তোমার, যে পোশাকে নিজেকে চিনতে সুবিধা হয়, সেটাই তোমার স্বকীয়তা।

তোমার ধর্মবিশ্বাস আজ লোকের কাছে খেলো লাগছে। কাল দেখবে ওটাই আবার ট্রেন্ডি হয়ে উঠবে। এর ওপর ভিত্তি করে নিজের বিশ্বাসটাই বদলাতে গেলে তোমার নিজেকে মানুষ মনে হবে কদিন?

এই রোজ বদলানো পৃথিবীতে একটা কনস্ট্যান্ট লাগে, জানো? গাইডিং স্টারের মতো। Moral compass এর মতো। তোমার চারপাশ বদলে গেলেও সেটা তোমার ভেতরে ধারণ করো তুমি। সেটাকে বিশ্বাস করো। সম্মান করো। যত্ন করে ধরে রাখো।

তোমার গন্তব্য বদলাতে পারে, পথ বদলাবে নিশ্চিত। ওই যে ভেতরের স্বকীয়তা, নিজের বিশ্বাসের ওপর অটল থাকার দৃঢ়তা, নিজের ওপর বিশ্বাস বল, ধর্মবিশ্বাস বল, তার একটা শক্ত ভিত্তি, ওই তোমাকে শক্তি যোগাবে।
পথ হারাবে না তুমি। মাঝে একটু ভুল রাস্তায় চলে গেলেও ফিরতে পারবে আবার। ওটুকু ধরে রেখো। কজন তোমাকে চিনল, কটা ভিউ হল, ওটা দেখে নিজের মূল্য নির্ধারণ করতে গেলে কি হয় জানো?

তোমার দামটা লোকের হাতে চলে যায়। সোনার বা ডলারের দামের মতো দাম বাড়তে বা কমতে থাকে যখন তখন। লোকের হাতে এ ক্ষমতা কেন দেবে তুমি? তুমি তো মানুষ। পণ্য না।

তোমাকে কোটি লোক চিনুক বা না চিনুক, তোমার অনেক ভিউ, লাইক, ভক্ত হোক বা না হোক, তুমি নিজে যেন তোমাকে চিনতে পারো।
সে আজ হোক, কাল হোক বা হোক পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার দিনটায়।

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট