চট্টগ্রাম বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

সর্বশেষ:

কার প্রশ্রয়ে বেপরোয়া ওরা

মোহাম্মদ আলী

৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ | ১২:৩৮ অপরাহ্ণ

আউট সোর্সিংয়ে লোক নিয়োগে বাণিজ্য, সহকর্মীদের উপর হামলা, জায়গা দখল, ঠিকাদারি বাণিজ্য, সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার, বদলি বাণিজ্য, ওয়াসার ঘর বরাদ্দ নিয়ে অন্যজনকে ভাড়া প্রদান ও  চাঁদাবাজির মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম ওয়াসার কিছু কর্মচারীর বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে ভুক্তভোগীরা অভিযুক্ত কর্মচারীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দাখিল করলেও কার্যত এখনো কোন প্রতিকার মিলেনি। ফলে অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

 

অভিযোগে জানা গেছে, ওয়াসার কর্মচারী রেজওয়ান হোসেন দুলাল, মোহাম্মদ জাকারিয়া, রুহুল আমিন, জমির খান মিয়াজী, এসকান্দর মিয়া, খোরশেদ আলমসহ আরো বেশ কয়েকজন কর্মচারী আউট সোর্সিংয়ে লোক নিয়োগে বাণিজ্য, সহকর্মীদের উপর হামলা, জায়গা দখল, ঠিকাদারি বাণিজ্য, সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার, বদলি বাণিজ্য, ওয়াসার ঘর বরাদ্দ নিয়ে অন্যজনকে ভাড়া প্রদান ও চাঁদাবাজির মতো গুরুতর কর্মকা-ে জড়িত রয়েছেন। এমন কি কথায় কথায় তারা সহকর্মীদের মারধর করছেন অহরহ। শুধু সহকর্মীদের উপর হামলা নয়, তারা বিভিন্ন সময়ে ওয়াসার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও রীতিমত শাসিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতেও কার্পণ্য করছেন না। অভিযোগে জানা গেছে, কয়েকদিন আগে ওয়াসা কর্মচারীদের অসাধু চক্রটি আউট সোর্সিংয়ে নিজেদের পছন্দ মতো লোক নিতে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে চাপ দিতে থাকেন। এতে ওই কর্মকর্তা রাজি না হওয়ায় তাকে হুমকি-ধমকি দেন তারা। তাতে অপমানিত হয়ে এক পর্যায়ে ওই কর্মকর্তা পদত্যাগ করতেও চান বলে জানা গেছে।

 

অনুসন্ধানে দেখা যায়, নগরীর লালখান বাজার এলাকার বাটালি হিলে রয়েছে ওয়াসার রিজার্ভার। এ রিজার্ভারের পাশে নিজে থাকার জন্য ওয়াসার জায়গায় দুই রুমের একটি পাকা ঘর বরাদ্দ নেয় ওয়াসার ড্রাইভার ও চট্টগ্রাম ওয়াসা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের (রেজি: নং ১০০৮) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এসকান্দর মিয়া। কিন্তু তিনি ওয়াসার বরাদ্দকৃত বাসায় বসবাস করেন না। উল্টো বরাদ্দকৃত বাসার পাশে ওয়াসার জায়গায় দখল করে আরো দুটি বাসা নির্মাণ করে বাইরের লোকজনকে ভাড়া দিয়ে দেন। গতকাল (মঙ্গলবার) বিকেলে সরেজমিনে পরিদর্শনে গেলে ওই বাসায় থাকা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র হাবিবুর রহমান সাফি দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘এসকান্দর মিয়া আমার সম্পর্কে মামা হন। তিনি এখানে বসবাস করেন না। এখানকার তিনটি ভাড়া বাসার মধ্যে আমরা একটিতে থাকি। অন্য দুটি বাসা ভাড়ায় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

 

বাটালি হিলের মতো একই অবস্থা দেখা গেছে নগরীর আইস ফ্যাক্টরি রোডের সরকারি সিটি কলেজ সংলগ্ন এলাকায়। এই এলাকায় ওয়াসার পাম্প হাউসের বাসা বরাদ্দ নেন ওয়াসার উচ্চমান সহকারী খোরশেদ আলম। তিনি আবার চট্টগ্রাম ওয়াসা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের (রেজি: নং ১০০৮) কার্যকরী সভাপতিও। এ সংগঠনের প্রভাব কাটিয়ে তিনি নিজের নামে বরাদ্দকৃত বাসা ভাড়া দেন স্থানীয় ‘বেঙ্গল স্টিল সোফা হাউস’ নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে। ওই ব্যবসায়ী ওয়াসার বরাদ্দকৃত বাসাকে রিমুভিং চেয়ার তৈরির কারখানা বানিয়ে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল (মঙ্গলবার) বিকেলে পরিদর্শনে গেলে কথা হয় ‘বেঙ্গল স্টিল সোফা হাউস’ এর মালিক মোহাম্মদ হাসানের সাথে। তিনি দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘ওয়াসার কর্মচারী খোরশেদ আলম আমার সম্পর্কে খালু হন। তার থেকে ভাড়া নিয়ে আমি চেয়ার তৈরির কারখানা বানিয়েছি।’

 

এদিকে গত ২৬ নভেম্বর বেলা আনুমানিক সাড়ে ১২টায় ওয়াসা ভবনে সহকারী পাম্প চালক মো. ইমতিয়াজ হাসানকে মারধর করেন একই সংস্থার কর্মচারী মো. জাকারিয়া, রুহুল আমিন, এসকান্দর মিয়া ও রেজোয়ান হোসেন দুলাল। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী কর্মচারী ইমতিয়াজ হাসান গত ৩০ নভেম্বর ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহকে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগে তিনি বলেন, ‘২০১৬ সাল থেকে দৈনিক ভিত্তিক কর্মচারী হিসেবে ওয়াসায় কর্মরত রয়েছেন। ওয়াসার সহকারী পাম্প চালক মো. জাকারিয়া চাকরি স্থায়ী করে দেওয়ার আশ^াস দিয়ে তার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নেন। পরবর্তীতে চাকরি স্থায়ী করতে না পারার নানা অজুহাত দিতে থাকলে মো. জাকারিয়াকে আমার টাকা ফেরত দিতে বলি। কিন্তু তিনি নানা তালবাহানা দিয়ে টাকা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানান। এ নিয়ে তার সাথে আমার মনোমালিন্য চলতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৬ নভেম্বর দুপুরে আমি ওয়াসা ভবনের জনতা ব্যাংকের কর্পোরেট শাখায় আমার একাউন্টে এক লাখ টাকা জমা দিতে গেলে সেখানে জাকারিয়া, রুহুল আমিন, এসকান্দর মিয়া ও রেজোয়ান হোসেন দুলালের সাথে দেখা হয়। এ সময় আমি জাকারিয়ার কাছে আমার ৫০ হাজার টাকা ফেরত চাইলে তিনিসহ অন্য চারজন উত্তেজিত হয়ে আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। তাতে আমি প্রতিবাদ করলে এক পর্যায়ে মো. জাকারিয়া, রুহুল আমিন, এসকান্দর মিয়া ও রেজোয়ান হোসেন দুলালসহ আরো কয়েকজন মিলে আমাকে চর থাপ্পর, কিল, ঘুষি, মারতে থাকে এবং আমার সাথে থাকা এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। আমার শোর চিৎকারে আশেপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে তারা আমাকে হুমকি প্রদান করেন যে, কি করে আমি ওয়াতে চাকরি করি তা তারা দেখে নেবে।’

 

এদিকে অসাধু চক্রটির বিরুদ্ধে ওয়াসার জায়গায় অবৈধভাবে দোকান নির্মাণে অসংখ্য অভিযোগ উঠে। এ নিয়ে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য গত ২২ নভেম্বর তদন্তে এসেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত টিম। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. এমদাদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত টিম ওইদিন বাকলিয়া খাজা রোডস্থ চট্টগ্রাম ওয়াসার ১৬নং পাম্পহাউসের জায়গায় অবৈধভাবে নির্মিত ৭টি দোকান ঘুরে দেখেন এবং স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে ঢাকায় ফিরে যান।

 

জানতে চাইলে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘ওয়াসা কর্মচারী মো. ইমতিয়াজ হাসানের অভিযোগ পেয়েছি। এটি তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছি।’

 

অভিযোগে জানা গেছে, বছরের পর বছর ধরে ওয়াসার গুটিকয়েক কর্মচারী শ্রমিক সংগঠনের নাম ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নেওয়ায় তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট