রবিবার প্রকাশিত চলতি বছরের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে প্রায় এক-চতুর্থাংশ অকৃতকার্য হওয়ার বিষয়টি অনাকাক্সিক্ষত। এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার এবার ফলাফলে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। এবার দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সাড়ে ১৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯২ হাজার ৩৬৫ জন।
অথচ গতবার ২০২২ খ্রিস্টাব্দে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। সেই হিসাবে এ বছর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৮৩ হাজার ৯১৭ জন। এ ছাড়া দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে এবার গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গতবার পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। গতবার এই হার ছিল ৮৫ দশমিক ৯৫। সে হিসেবে এ বছর পাসের হার কমেছে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর এবারই পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। কেবল তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে ৭৫ নম্বরে পরীক্ষা হয়েছে। যার কারণে পরীক্ষার ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কিন্তু প্রশ্নটি হচ্ছে, প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হলো কেন? এর পেছনে নিশ্চয়ই অন্য আরো অনেক কারণ আছে। সন্দেহ নেই, সে সব কারণ শনাক্ত করে যথাযথ সমাধান-উদ্যোগ না নিলে আগামিতেও ফল-বিপর্যয় এবং শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকবে।
উল্লেখ্য, শুধু ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৭৫ দশমিক ৯ শতাংশ। পাশের হার সবচেয়ে বেশি কারিগরি শিক্ষাবোর্ডে, পাসের হার ৯১ দশমিক ২৫ শতাংশ। এরপর রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড। এবার মাদরাসা বোর্ডে ৯০ দশমিক ৭৫ শতাংশ পাস করেছে। তবে গতবছরের চেয়ে এবার পাশের হার কম। গত বছর পাসের হার ছিল ৯২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। সেই হিসাবে আলিমে পাসে হার প্রায় এক দশমিক ৮১ শতাংশ কমেছে। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পাশের হারও তেমন সন্তোষজনক নয়। পাশের হার ৭৪.৪৫। বলা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের কারণেই চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার কম। তবে এটি একমাত্র কারণ নয়। অন্য অনেক কারণ আছে। কারণ শনাক্ত করে জরুরি প্রতিবিধান উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাসের হার শূন্য তার কারণ অনুসন্ধান করেও পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। দেখা যাচ্ছে, যেসব বোর্ডে গণিত ও ইংরেজি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা ভালো করেছেন, সেসব বোর্ডে পাসের হার বেশি। সংগতকারণে যেসব বোর্ডে ফল তুলনামূলকভাবে খারাপ হয়েছে তাদের উচিত হবে বিষয়টি আমলে নিয়ে আগামির প্রস্তুতি নেয়া।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গতবারের ন্যায় এবারও এইচএসসি-সমমান পরীক্ষার ফলাফলে মেয়েদের পাশের হার ছেলেদের তুলনায় তিন দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি। জিপিএতেও মেয়েরা এগিয়ে। যদিও আর্থ-সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকসহ নানাকারণে গত কয়েকবছর ধরে নারীশিক্ষার্থীদের ঝরেপড়ার হার জ্যামিতিক হারে বাড়ছে, তবে শিক্ষা-দীক্ষা এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও ফলাফলে তারা ভালো করছে। এবারের এইচএসসির ফলেও তার ছাপ রয়েছে। ফলাফলে এবারও এগিয়ে মেয়েরা। পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে তারা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে আছে। ছাত্রীদের এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি খুবই আশাব্যঞ্জক, সন্দেহ নেই। তবে ছাত্ররা কেন পিছিয়ে যাচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাশের হার ও শিক্ষার মান বাড়াতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি ইতিবাচক। তবে মান ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর সুচিন্তিত উদ্যোগও থাকতে হবে। একথা অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, শিক্ষার্থীদের জীবনে উচ্চমাধ্যমিকের ফল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে তারা উচ্চশিক্ষার বৃহত্তর জগতে প্রবেশের সুযোগ পায়, যা তাদের জীবন গঠন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। তাই এ পর্যায়ের পড়াশোনা ও ফলাফলের গুরুত্ব অনেক বেশি। সংগতকারণে পাশের হার ও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির ব্যাপারে সুপরিকল্পনা জরুরি। শিক্ষার গুণগত মান না বাড়লে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে পড়বে। আর পাশের হার বৃদ্ধি ও শিক্ষার মান উন্নত করতে আমাদের প্রয়োজন ভালো শিক্ষক, প্রশিক্ষণে জোর দেওয়া ও শিক্ষকদের ওপর নজরদারি বাড়ানো। পাঠ্য বইও আকর্ষণীয় করতে হবে। আনন্দদায়ক করতে হবে শ্রেণিকক্ষের পাঠদান। যোগ্যরাই যাতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এবার যারা এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, তাদের সবার প্রতি রইল আমাদের অভিনন্দন। যারা অকৃতকার্য হয়েছে, তাদেরও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আগামীতে ভালো ফলের জন্য এখন থেকেই তাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।
পূর্বকোণ/আরডি