৯ জন গ্রাহকের চেক জালিয়াতি করে গ্রাহকের টাকা আত্মসাত করার ঘটনায় ইসলামী ব্যাংক টেকনাফ শাখার তিন কর্মকর্তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আবেদন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। আদালত আগামী ২৯ নভেম্বর শুনানির দিন ধার্য করেছেন। একইসাথে তাদের ৩ জনকে দুদকের দায়েরকৃত মামলায়ও গ্রেপ্তার (শ্যোন অ্যারেস্ট) দেখানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল বুধবার দুদক কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বাদি হয়ে বিরুদ্ধে তাদের বিরুদ্ধে নিজ কার্যালয়ে মামলা করেন।
বুধবার (২২ নভেম্বর) কক্সবাজার সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দুদক কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. নাছরুল্লাহ হোসাইন রিমান্ডের আবেদন করেন।
আটককৃত তিন কর্মকর্তা হলেন ইসলামী ব্যাংক টেকনাফ শাখার বরখাস্তকৃত অফিসার ঈমাম হোসেন (৩৭), জুনিয়র অফিসার আজিজ আহমদ জাবেদ (৩০) ও মোহাম্মদ শাহেদুল ইসলাম (৩১)। তাদের মধ্যে ঈমাম হোসেন টেকনাফের হ্নীলা দমদমিয়া এলাকার ঠান্ডা মিয়ার ছেলে, আজিজ আহমদ জাবেদ চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার জঙ্গলখাইনের ইউনিয়ের উজিরপুর গ্রামের মীর আহমদের ছেলে এবং মোহাম্মদ শাহেদুল ইসলাম একই উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের চরকানাই এলাকার শেখ আমিনুল হকের ছেলে।
মামলার সুত্রে বিষয়টি নিশ্চিত করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দুদক কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. নাছরুল্লাহ হোসাইন জানান, টাকা আত্মসাতের ঘটনায় আসামিদের সম্পৃক্ততা নির্ধারণ ও আরও কোন অবৈধ লেনদেন আছে কিনা এ বিষয়ে জানাসহ এ ঘটনায় অন্য কারো সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা উদ্ঘাটনের জন্য আসামিদেরকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। ওই ৩ কর্মকর্তা মিলে চলতি বছররের আহমেদ হোসেন নামে এক গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ২০১৩ সালের ২৮ আগস্ট নগদ উত্তোলনের মাধ্যমে ১ লাখ, চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি নগদ উত্তোলনের মাধ্যমে ৫০ হাজার, ৩০ জানুয়ারি ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে ৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এছাড়াও চলতি বছরের ২৮ ফেব্রæয়ারি জামাল হোসেন নামে এক গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে নগদ ৩ লাখ ৫০ হাজার, ১৭ জুলাই মোহাম্মদ হোসেন নামে এক গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে নগদ উত্তোলনের মাধ্যমে ১ লাখ ৫০ হাজার, ২৫ সেপ্টেম্বর আনোয়ারা বেগম নামে এক গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে ৮ লাখ, একইদিন ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে নুর মোহাম্মদ নামে এক গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮ লাখ, মং ক্যুয়া চান নামে এক গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে ২০ লাখ, জয়নাল আবেদীন নামে এক গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে একই পদ্ধতিতে ৭ লাখ ৫০ হাজার, ২৭ সেপ্টেম্বর লাল মিয়া নামে এক গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে নগদ উত্তোলনের ৩ লাখ ২২ হাজার, ২ অক্টোবর আবদুল গফুর নামে এক গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে নগদ উত্তোলনের ৪ লাখ ৩৫ হাজার এবং ৯ অক্টোবর একই পদ্ধতিতে একই গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ১ লাখ ৭৮ হাজার টাকাসহ মোট ৬২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন তারা। গত ৬ নভেম্বর ইসলামী ব্যাংক টেকনাফ শাখায় একজন গ্রাহক তার হিসাবের স্থিতিতে গরমিল পাওয়ায় শাখা ব্যবস্থাপক মুহাম্মদ আলতাফ হোসেনের কাছে মৌখিক অভিযোগ করেন। ওই মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে তার হিসাবের স্থিতির গরমিলের ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করে অভিযোগের সত্যতা পান তিনি। একইভাবে ১২ নভেম্বর অন্য এক গ্রাহক তার হিসাবের স্থিতির ব্যাপারেও একই অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগেরও শাখা ব্যবস্থাপক যাচাই-বাছাই করে সত্যতা পান। অভিযোগ যাচাই-বাছাই করার সময় শাখা ব্যবস্থাপক ওই শাখার অফিসার ঈমাম হোসেন, জুনিয়র অফিসার আজিজ আহমেদ জাবেদ এবং মোহাম্মদ শাহেদুল ইসলামের সম্পৃক্ততা পান। তারা ব্যাংক প্রদত্ত নিজ নিজ আইডি ব্যবহার করে পরস্পর চেক জালিয়াতির মাধ্যমে ইস্যু করে এবং চেকগুলো ব্যবহার করে নগদ ও স্থানান্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রাহকের হিসাব থেকে অবৈধ পন্থায় টাকা উত্তোলন করেন। তাদের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রাহকের হিসাবে সেই টাকাগুলো স্থানান্তর করা হয়েছিল। বিষয়টি ব্যবস্থাপক নিশ্চিত হওয়ার পর দ্রæত আঞ্চলিক প্রধানকে অবহিত করে নিরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। বিভিন্ন গ্রাহকের হিসাব থেকে সর্বমোট ৫৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা অননুমোদিত উপায়ে উত্তোলন করা হয়। একই ভিত্তিতে ব্যাংকের কর্মকর্তা অভিযুক্ত ইমাম হোসেনকে ব্যবস্থাপক জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে লিখিত স্বীকৃতি দেন। একইসাথে অভিযোগকারী ২ গ্রাহকের হিসাবের গরমিলে ১৩ লাখ টাকা ব্যবস্থা করে তাদের অভিযোগ তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তি করেন ব্যবস্থাপক। বরখাস্তকৃত অফিসার ঈমাম হোসেনের লিখিত স্বীকৃতি অনুযায়ী, তিনি নিজেই ৩০ লাখ টাকা, আজিজ আহমদ জাবেদ ৩০ লাখ টাকা এবং মোহাম্মদ শাহেদুল ইসলাম ৫ লাখ টাকা পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে ভাগ-ভাটোয়ারা করে নিয়েছেন। অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করে শাখাটির ৯ জন গ্রাহকের হিসাব থেকে ৬২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা অবৈধভাবে উত্তোলন করে অপরাধজনক বিশ্বাস ভঙ্গের মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগ এনে দন্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারায় টেকনাফ শাখা ব্যবস্থাপক বাদি হয়ে টেকনাফ মডেল থানায় মামলা দায়ের হয়েছে। ওই মামলায় গত ১৫ নভেম্বর তারা তিনজন টেকনাফ মডল থানা পুলিশের হাতে আটক হয়ে কারাগারে রয়েছেন। এরপর ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে পুনরায় মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলার তদন্তকালে অন্য কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে বা ভিন্ন কোন তথ্য পাওয়া গেলে তাও আমলে নেয়া হবে।
পূর্বকোণ/রাজীব/এএইচ