আজ বিশ্ব টেলিভিশন দিবস
দর্শক হারাচ্ছে টিভি চ্যানেল
এক সময় মানুষের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল দেশীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। কিন্তু এখন টেলিভিশন চ্যানেল তার সেই জৌলুশ হারিয়ে ফেলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহজলভ্যতা, টিভি চ্যানেলগুলোতে অনুষ্ঠানের ধারাবাহিতকার অভাব, অতি লাভের আশায় বিজ্ঞাপনের প্রচারপ্রসার এবং পুরোনো সিনেমা কিংবা অনুষ্ঠানগুলো বারবার দেখানো।
আজ বিশ্ব টেলিভিশন দিবস। টেলিভিশনের সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হলে বর্তমান সময়ের তরুণ নির্মাতাদের নির্মিত চলচ্চিত্র প্রকাশ-প্রচার এবং অনুষ্ঠানের ধারাবাহিতা রক্ষা করে অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। কারণ এখনের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলো নির্মিত হচ্ছে ইতিহাস নির্ভর এবং তথ্যবহুল। তাহলেই টেলিভিশন আবার ফিরে পাবে তার পুরোনো ঐতিহ্য। বিশ্ব টেলিভিশন দিবসে টেলিভিশনের হারানো ঐতিহ্য কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এ নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সভাপতি, চবি নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা শৈবাল চৌধুরী, লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা লিটন কর ও চলচ্চিত্র নির্মাতা শায়লা রহমান তিথির সাথে।
বিজ্ঞাপন প্রচারে
সচেতন হতে হবে
১৯৭৬ সালের দিকে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশে। চট্টগ্রামে ৮০’র দশকের দিকে আমরা টেলিভিশন দেখতে পাই। তখন টেলিভিশনে অনুষ্ঠানের সময় ছিল মাত্র ছয় ঘণ্টা। সেই অল্প সময়ে টিভিতে অনুষ্ঠান দেখতে আমরা অপেক্ষা করতাম। পরে ধীরে ধীরে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান প্রচারের সময় বাড়ে। একটা পর্যায় এসে অনেকগুলো প্রাইভেট চ্যানেল যোগ হয়। চ্যানেলগুলো সেসময় বেশ রমরমা ছিল। কিন্তু একটা সময় এসে চ্যানেলগুলো তাদের ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলে। অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্য নেই, গড়বাধা অনুষ্ঠানগুলো প্রতিদিন চলতে থাকে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা খবর প্রচার করতে থাকে, রুচিশীল বিজ্ঞাপনের বদলে কিছুক্ষণ পরপর অর্থহীন বিজ্ঞাপন দেখাতে থাকে। নেই কোনো শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, বিদেশী কিছু টিভি সিরিয়াল বাংলায় ডাবিং করে যেনতেনভাবে দেখানো হচ্ছে, মানসম্মত সিনেমা তৈরি হচ্ছে না এসবে দর্শক বিরক্ত হয়েই টেলিভিশন বিমুখ হয়ে গেছে।
আমার মতে সুস্থ মানুষ এখন টিভি দেখলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এদিকে বর্তমানে মানুষের হাতে হাতে স্মার্ট ফোন আছে। তারা এর মাধ্যমে চাইলেই যেকোনো কিছু দেখতে পারে। এ জন্য আগে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে বিজ্ঞাপন প্রচারের বিষয়ে সচেতন হতে হবে, খবর সংক্ষিপ্ত করতে হবে, নতুন ও অর্থবহুল চলচ্চিত্র যারা নির্মাণ করছে তাদের চলচ্চিত্রগুলো দর্শকের কাছে যেভাবে পৌঁছাবে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের প্রচার বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে আবার সেই পুরোনো দিনে ফিরে যেতে হবে। যেমন, টেলিভিশনের প্রচারণার সময় আগের মত কমিয়ে দিকে হবে।
শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র
প্রচার করতে হবে
আমরা যখন ছোট ছিলাম টেলিভিশনের একটি সোনালী যুগ দেখেছিলাম। যা মনে রাখার মত ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি অপেক্ষা করতাম টেলিভিশনে সিনেমা, নাটকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখার। এখন আর এটি দেখা যায় না। এর প্রধান কারণ দর্শক আকৃষ্ট হয় এমন চলচ্চিত্র কিংবা নাটক তৈরি হচ্ছে না। আরো একটি কারণ হচ্ছে আগে থেকে যারা চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত ছিলেন দেখা যায়, ঘুরে ফিরে সেই পুরোনো চলচ্চিত্রগুলোকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। যেগুলো মানুষ দেখতে দেখতে দেখার আর কিছু নেই। কিন্তু বর্তমান অনেক তরুণ নির্মাতা আছে যারা অসাধারণ কাজ করছেন। শিক্ষামূলক ইতিহাস নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। অথচ নতুন এবং তরুণ এ নির্মাতারা আর্থিক সংকটের কারণে নানা প্রতিবন্ধকতায় তাদের নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো মানুষের সামনে আনতে পারছে না।
কোনো নির্মাতা যদি একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তবে এটি প্রদর্শনী পর্যন্ত আনতে তাকে যে কি পরিমাণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় এটি শুধু সেই জানেন। একারণেও ভালো চলচ্চিত্রগুলো দর্শক পাচ্ছেন না। যদি আগের মত আর্থিক সহায়তা নিয়ে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসেন তবে ভালো চলচ্চিত্রগুলো প্রচার হবে। টেলিভিশন ফিরে পাবেন হারানো ঐতিহ্য। চলতি মাসের সাত নভেম্বর ঢাকা জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে আমার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘জয় বাংলা’ প্রদর্শীত হয়েছে। এ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে মূলত মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের ইতিহাস নিয়ে। এটি একটি শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র। এমন চলচ্চিত্রগুলো শিক্ষার্থীদের দেখার সুযোগ করে দিলে এবং টেলিভিশনে প্রচারের ব্যবস্থা করলে এভাবে মানুষ আবার টেলিভিশন মুখি হবে।
মানুষের জীবনের গল্প
তুলে ধরতে হবে
যখন শুরু বিটিভি ছিল তারপর কিছু প্রাইভেট টিভি চ্যানেল আসে তখন কিছু ভালো ভালো কন্টেন্ট তৈরি হত। সেই কন্টেন্টগুলোতে নির্মাতারা মানুষের জীবনের গল্প নিয়েই সিনেমা তৈরি করতো। সেগুলো সাধারণ মানুষের জীবনের সাথে মিলে যেত। যা সাধারণ দর্শকদের আকৃষ্ট করতো। একারণে তখন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে জানার শিক্ষার অনেক কিছু ছিল যা মানুষকে টিভি দেখতে উৎসাহিত করতো। এর পরবর্তী সময়ে একসাথে অনেকগুলো টেলিভিশন চ্যানেল আসে। সেগুলোতে সেইভাবে অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য কন্টেন্ট তৈরি হতো না কিংবা সেইভাবে নির্মাতাও তৈরি হয়নি। এতে সবগুলো চ্যানেল একই অনুষ্ঠান ঘুরে ফিরে বারবার দেখাতে থাকে এবং যদি টিভি চ্যানেলের লোগোটা ঢেকে রাখা হয় বুঝা মুসকিল এটি কোন চ্যানেল।
এছাড়া দৈনন্দিন জীবনের সাথে মিল রেখে জানার, শিখার কোনো কন্টেন্ট তৈরি হচ্ছে না। এসব কারণে মানুষ টেলিভিশনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে পেলেছে। টেলিভিশন হচ্ছে এমন একটি মাধ্যম যেটি মানুষের বসা- শুয়ার ঘুর পর্যন্ত ঢুকে যেতে পারে। তাই এমন একটি পাওয়ারফুল মাধ্যামকে ক্রিয়েটিভিটির বাইরে গিয়ে শুধুমাত্র ব্যবসার মাধ্যম হিসেবে চিন্তা না করে সৃজনশীল অনুষ্ঠানের প্রচারের মাধ্যমে মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে।
পূর্বকোণ/আরডি