চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

গৌরবের ৫৮ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সুশীল বড়ুয়া

১৮ নভেম্বর, ২০২৩ | ৪:২২ অপরাহ্ণ

বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে উচ্চশিক্ষা প্রদান করা, গবেষণামূলক কার্যকর্ম করা এবং এর পাশাপাশি জ্ঞান উৎপাদন করে তা বিতরণ করা। এর পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক সংজ্ঞা হলো হাজার বছরের জ্ঞান সংরক্ষণ, জ্ঞান বিতরণ ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টির কর্তব্য পালন করা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে- বিশেষ দেশ, বিশেষ জাতি যে বিদ্যা সম্বন্ধে বিশেষ প্রীতি, গৌরব ও দায়িত্ব অনুভব করেছে তাকে রক্ষা ও প্রচারের জন্য স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সৃষ্টি। বিশ্বে প্রথম ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তক্ষশিলা, নালন্দা ও বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘তাদের উদ্ভব ভারতীয় চিত্তের আন্তরিক প্রেরণায় ও স্বভাবের অনিবার্য আবেগে’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরো বলেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কি… ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যানের আসন চির প্রসিদ্ধ এবং বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ সাধনার ক্ষেত্র। বিশ্ববিদ্যালয় হলো বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞান সৃজন ও সঞ্চালনের প্রতিষ্ঠান’। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো- ‘সার্টিফিকেট অর্জন নয়, প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠার প্রতিষ্ঠান। অন্যভাবে বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞা হলো- ‘মনটাকে বিশ্বের মত বড় করে চিন্তা করতে পারা যায় যে পযার্য়ে গিয়ে, সেটার নাম বিশ্ববিদ্যালয়’। বিশ্বিবদ্যালয় হলো- ‘চিন্তার স্বাধীনতা আর বুদ্ধিমুক্তির কেন্দ্র, চিন্তার স্বাধীনতা আর বুদ্ধির মুক্তি না হলে আলোকিত মানুষ হওয়া যায় না এবং আলোকিত মানুষ তৈরি করা যায়না।’ আর বিশ্ববিদ্যালয় হবে ভিন্নমতের চারণভূমি।

 

স্বাধীন চিন্তা বিকাশের জন্য ভিন্নমতের পৃষ্ঠপোষক হবে  বিশ্ববিদ্যালয়। তাই ভলতেয়ার বলেছিলেন- ‘তুমি যা বলো তা আমি ঘৃণা করি; কিন্তু তোমার তা বলার অধিকার আমি প্রাণ দিয়ে সংরক্ষণ করবো’। তাই বলতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শুধু প্রজ্ঞা-সংজ্ঞার ফেরিওয়ালা নন। তাকে হতে হবে মনুষ্যত্বের বাতিঘর। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন-বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো বিদ্যা উৎপাদন করা। উৎপাদিত বিদ্যা বিতরণ করে ছাত্রদেরকে মুক্তি বুদ্ধির বাতিঘরে পরিণত করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা হবেন সর্বাধুনিক, সময় যুগ ও সমাজ সচেতন। একদিকে তারা যেমন হবেন অসীম জ্ঞান গরিমার আধার, তেমনি সত্য, ন্যায়, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, মূল্যবোধ সব মানবীয় গুণাবলীর ধারক ও বাহক। তাদের চিন্তাচেতনা হবে যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। তারা হবেন সব অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে মূর্তপ্রতিক। একজন গ্রাজুয়েট তৈরীতে রাষ্ট্রের খরচ হয় নব্বই লাখ থেকে এক কোটি টাকা। এই টাকা আসে দেশের চাষী, মজুর, শ্রমিক, রিকসাওয়ালা সহ খেটে খাওয়া মানুষের ট্যাক্সের টাকায়। তাই নতুন বের হওয়া প্রত্যেক গ্রাজুয়েটদের সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে।  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালে ১৮নভেম্বর। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুমানিক ত্রিশ হাজার ছাত্র ছাত্রী অধ্যায়ন করেন এবং শিক্ষক শিক্ষয়িত্রীর সংখ্যা ও প্রায় হাজারের কাছাকাছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবজনক ভূমিকা রয়েছে। ছয়দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে এবং মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা অতুলনীয়। মুক্তিযুদ্ধে  বিশ্ববিদ্যালয়ের ষোলজন শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারী শহীদ হয়েছেন। একজন শহীদ ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। তার নাম হলো মোহাম্মদ হোসেন। চাকসুর নির্বাচিত জিএস আবদুর রবও শহীদ  হয়েছেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বহু শিক্ষক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা এবং গবেষণার সাথে জড়িত ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ২০০৬সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গণিতবিদ, পর্দাথবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদ প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চারুশিল্পী প্রফেসর রশীদ চৌধুরীও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৬সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদিকে সুবর্ণযুগ। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন দেশী-বিদেশী খ্যাতিমান প্রফেসরবৃন্দ। অন্যদিকে স্বাধীনতার সোনালি প্রজন্ম হিসেবে বহু ছাত্রছাত্রী কৃতিত্বের সাথে  শিক্ষাজীবন শেষ করে দেশ-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এই সময়ে ছাত্রছাত্রীদের গণতান্ত্রিক চেতনা বিকশিত করার মানসে সঠিক সময়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। সাংস্কৃতিক, বির্তক প্রতিযোগিতা, মানসিক ও শারীরিক উৎকর্ষ সাধনে ছাত্রসংসদের মাধ্যমে প্রতিবছর সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে পরিচালিত হবে তা নির্ভর করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের চিন্তাচেতনার উপর। উপাচার্যকে কেন্দ্র করে শিক্ষক, ছাত্ররাজনীতি ও কর্মচারী সমিতি গঠিত এবং পরিচালিত হয়। আশির দশক থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় ‘গ্রহণ কাল’। এই সময়ে সাম্প্রদায়িকতা ও আঞ্চলিকতা হাত ধরাধরি করে বিকশিত হতে থাকে। অভিযোগ আছে, সেই সময়ে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দেশের দুইজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেননি তখনকার কর্তৃপক্ষ। ছাত্ররাজনীতিকে ধ্বংস করার জন্য তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় চাপাতি ও হকিস্টিক। আঞ্চলিকতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কীর্তিমান স্বনামধন্য অনেক প্রফেসর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়ারও অভিযোগ আছে। অভিযোগ আছে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে লক্ষ লক্ষ টাকা উৎকোচ গ্রহণ এবং আত্মীয় স্বজনের নিয়োগ বিষয়েও। পত্রিকায়ও বিভিন্ন সময় এসব বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এভাবে মেধাবীরা নিয়োগ না পেয়ে অযোগ্যরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার প্রভাব পড়ে শিক্ষার মানেও। এতে যোগ্য মানবসম্পদ তৈরিতে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে।

 

উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন বৈশ্বিক চাহিদা বিবেচনা করে নিজেদের চাহিদা মতো শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষার বৈশ্বিক চাহিদার দিকে খেয়াল রেখে রূপান্তর করা উচিত। সার্বিক এই শিক্ষাকাঠামো রূপান্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শিক্ষকসমাজ। কাজেই পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণ, প্রয়োজনীয় যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ এবং পেশাগত উন্নয়ন প্রক্রিয়া কাঠামো ঢেলে সাজানো উচিত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারী রাজনীতির চরিত্র সকল কিছুকে ছাড়িয়ে উপাচার্যনির্ভর হয়ে যাওয়ার অভিযোগও উঠেছে। বলা হচ্ছে যে শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি প্রগতিশীল বলে পরিচিতি পেয়েছিল, তা এখন উপাচার্যনির্ভর ব্যক্তি স্বার্থবাদী রাজনীতিতে রূপান্তর ঘটেছে। ফলে প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারী শিক্ষকসমাজের আর কোন ভূমিকা রইল থাকছে না দেশের গণতান্ত্রিক ও সামাজিক আন্দোলনে। প্রগতিশীলতার মুখোশই শুধু রইলো, কিন্তু পরিণত হলো রক্ষণশীল হিসেবে। অন্যদিকে মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও অনেকেই নিজেদের স্বার্থে সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথেও আপোস করছে। এটিও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যারা দেশ ও জনস্বার্থ নিয়ে ভাবেন, দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে তাদের এগিয়ে আসা উচিত। আমরা চাই আমাদের প্রাণের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকার অর্থে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বখ্যাত জ্ঞানকেন্দ্র হয়ে উঠুক।

 

পূর্বকোণ/আরডি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট