চট্টগ্রাম বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

রিউমাটলজীর পথিকৃৎ প্রফেসর ডা. সৈয়দ আতিকুল হকের ‘এসিআর মাস্টার’ খেতাব অর্জন

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন

১৬ নভেম্বর, ২০২৩ | ১২:৫৪ অপরাহ্ণ

নভেম্বর এর ১০ তারিখ ক্যালি ফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো শহরে বসেছে আমেরিকান কলেজ অব রিউমা টোলজীর বাৎসরিক মিটিং। সারা দুনিয়ার তাবৎ নামকরা রিউমাটোলজিস্ট এই মিটিং-এ উপস্থিত। আর সেই মিটিং-এর মাইক্রোফোনে উচ্চারিত হলো বাংলাদেশের রিউমাটোলজির বিখ্যাত ডাক্তার প্রফেসর সৈয়দ আতিকুল হকের নাম। আমেরিকান কলেজ অফ রিউমাটোলজী প্রতি বছর পৃথিবীর স্বনামধন্য কিছু রিউমাটোলজীর ডাক্তারদেরকে ‘এসিআর মাস্টার’ হিসাবে একটি লাইফটাইম এচিভমেন্ট পুরস্কার দিয়ে থাকেন। এই বছর প্রফেসর ডা. সৈয়দ আতিকুল হক এই বিরল সন্মান অর্জনের একজন। এই প্রথম একজন বাংলাদেশী ডাক্তার এই সম্মাননা পেলেন।

 

ডা. সৈয়দ আতিকুল হক আমাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজেরই একজন গ্রাজুয়েট। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে আউটস্টেন্ডিং গ্রেড নিয়ে এমবিবিএস করার পর ডা. আতিক বুলগেরিয়ায় মেডিসিনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সালে এদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। আমি ইন্টার্ন ডকটর হিসাবে কাজ করার সময় প্রফেসর ডা. সৈয়দ আতিকুল হক এর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়। আমার আলমা মেটার প্রফেসর সৈয়দ আতিকুল হক ১৯৯২ সালে বর্তমান বিএসএমএমইউতে মেডিসিন ফ্যাকাল্টিতে যোগদান করেন। ঐ সময় রিউমাটোলজী নামে বাংলাদেশে কোন ডিপার্টমেন্ট ছিল না।

 

রিউমাটোলজী হলো মেডিসিনের একটি শাখা যেখানে মূলত বাতজনিত রোগ বা রিউম্যাটিজম এর চিকিৎসা করা হয়। এই রোগে আক্রান্ত হলে কঙ্কালতন্ত্র ও জয়েন্ট এর দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত ব্যাথা হয়ে থাকে। এটি আসলে নির্দিষ্ট কোনো রোগ না, তবে গেঁটেবাত (আর্র্থ্রাইটিস) ও নন-আর্টিকুলার রিউম্যাটিজম সহ কমপক্ষে ২০০টি বিভিন্ন প্রকারের বাতজনিত রোগের সমাহার।

 

ডা. আতিক প্রফেসর এম আলম স্যার এর তত্বাবধানে ১৯৯১ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে বিএসএমএমইউ হাসপাতাল এ রিউমাটোলজী ক্লিনিক এর যাত্রা শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে ডা. আতিক সিংগাপুরে রিউমাটোলজীতে স্বল্পকালীন কোর্স সমাপ্ত করেন এবং ধীরে ধীরে বিএসএমএমইউ হাসপাতাল এ একটি পূর্র্ণাঙ্গ রিউমাটোলজী বিভাগ গড়ে তুলেন। সমকালীন সময়ে ডা. আতিকুল হক প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ রিউমাটোলজী সোসাইটি। ২০০৬ সালে তিনি বাংলাদেশে প্রথম রিউমাটোলজীর প্রফেসর হিসাবে অভিষিক্ত হন। আমার আলমা মেটার আতিক ভাই এর সাথে ফোনালাপে জানা যায় যে ২০১৩ সাল থেকে উনার প্রচেস্টা শুরু হয়েছিল ৮টি ডিভিশনাল মেডিকেল কলেজে হাসপাতাল এ পূর্ণাঙ্গ রিউমাটোলজী বিভাগ চালু করা। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালে রিউমাটোলজী বিভাগ খোলার অনুমোদন পত্রে স্বাক্ষর করেন। ইতিমধ্যে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এ রিউমাটোলজী বিভাগ পূর্ণাঙ্গ সেবা দেওয়া শুরু করেছে।

 

ইতিমধ্যে প্রফেসর আতিক এশিয়া প্যাসিফিক এর বিভিন্ন রিউমাটোলজী সোসাইটির সাথে বাংলাদেশ এর যোগসূত্র গড়ে তুলেন এবং নিজেকে রিউমাটোলজীর লীডারশীপ রোল এ নিয়ে যান। যার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ও পাকিস্তান এর রিউমাটোলজী সোসাইটির সাপোর্ট এর ফলে ২০১৮-২০ সালে এশিয়া প্যাসিফিক লীগ এগেন্সট রিউমাটোলজীর (APLAR) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং অত্যন্ত সফলতার সাথে তার দায়িত্ত পালন করেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে প্রফেসর আতিক এর নেতৃত্বে রিউমাটোলজী রোগ সম্পর্কে শুরু হয় সামাজিক সচেতনেতার। বাংলাদেশে বর্তমানে ৭০ জনের মতো রিউমাটোলজিস্ট আছেন বলে জানা যায়। প্রফেসর আতিক এর মতে দেশে বাতজনিত রোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ২ কোটির উপর।

 

APLAR প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন প্রফেসর আতিক বাংলাদেশের রিউমাটোলজিস্টদের সাথে প্রতিবেশী দেশ বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের রিউমাটোলজিস্টদের সাথে একটি সন্মানজনক সাইন্টিফিক সেতুবন্ধন গড়ে তুলেন। যার পরিপেক্ষিতে ডা. আতিকের কাজকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পাকিস্তান এর বিখ্যাত রিউমাটোলজিস্ট প্রফেসর নিঘাত আহমেদ মীর প্রফেসর সৈয়দ আতিকুল হকের নাম আমেরিকান কলেজ অব রিউমাটোলজীতে ‘এসিআর মাস্টার’ খেতাব এর জন্য প্রপোজাল সাবমিট করেন এবং সেই প্রপোজালকে সাপোর্ট করেন ভারতের আরেকজন এসিআর মাস্টার বিখ্যাত রিউমাটোলজিস্ট প্রফেসর ডা. দেবাশীষ ডানডা এবং ইউরোপীয় রিউমাটোলজীর সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ইয়ান ম্যাকিনেস।

 

এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। আমাদের বাংলাদেশ এর মেডিসিন এর মান বাড়ানো এবং স্পেসিয়ালাইজ্ধসঢ়;ড ট্রেনিং এর জন্য ভারতের সাথে কোলাবোরেশন করা জরুরি। বর্তমানে বাংলাদেশের হাজার হাজার রোগী ভারতে যায় উন্নত চিকিৎসার জন্য। সুতরাং আমাদের চিকিৎসার মান ভারতের সমপর্যায় অথবা তার কাছাকাছি যদি নিতে না পারি তাহলে ভবিষ্যতে এই গ্যাপ অনেক বাড়বে। আমি মনে করি প্রফেসর আতিক অন্ততপক্ষে কিছুটা হলেও সেই গ্যাপকে কাছাকাছি নিয়ে গেছেন। যার জন্য উনাকে ভারত এবং পাকিস্তান এর বিখ্যাত ডাক্তার এসিআর মাস্টার এ্যাওয়ার্ড এর জন্য নমিনেশন করতে দ্বিধা করেন নাই। উনার এই অর্জন এর জন্য চট্টগ্রাম তথা সমগ্র বাংলাদেশ এর মেডিকেল কমিউনিটি সত্যিকারভাবে গর্বিত।

 

প্রফেসর সৈয়দ আতিকুল হক চট্টগ্রামের পটিয়ার সন্তান। উনার বাবা ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনাব সৈয়দ সিরাজুল হক। উনার ছোট ভাই সৈয়দ সাহেদুল হক কানাডায় কর্মরত চিকিৎসক এবং আমার ব্যাচম্যাট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এর ছাত্র। উনার বড় ভাই ও এক বোন বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার এবং আমেরিকায় কর্মরত। বাকী তিন বোনের মধ্যে আরো এক বোন ডাক্তার, আরেক বোন বাংলাতে এম এ করে সাংবাদিকতা করেন। ছোট বোন স্বাস্থ্যবিষয়ক অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করেছেন। প্রফেসর সৈয়দ আতিকুল হককে আমার আলমা মেটার চিটাগাং মেডিকেল কলেজ এর পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা।

 

পূর্বকোণ/আরডি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট