চট্টগ্রাম রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

শুভ জন্মদিন কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ

‘পাঠক হৃদয়ে বেঁচে থাকুন আজীবন’

হাসান আহমেদ

১৩ নভেম্বর, ২০২৩ | ৪:১০ অপরাহ্ণ

উপমহাদেশের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ সালে নেত্রকোনা জেলায়।বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজ থেকে। এরপর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে অধ্যয়ন সম্পন্ন করে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ড্যাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পলিমার রসায়ন বিষয়ে পিএইচডি করেন। হুমায়ুন আহমেদ তার নিজের বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে লেখালেখিতে মনোনিবেশের উদ্দেশ্যে শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। হুমায়ূন আহমেদের নামের সাথে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও কিছুটা জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গ্রেফতার হয়েছিলেন, গুলিও চালানো হয়েছিল। বেঁচে যান অলৌকিকভাবে।

মানুষটির সাহিত্যে পদার্পণের শুরুটা হয়েছিল ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাস দিয়ে ১৯৭২ সালে। সেই থেকে শুরু করে মৃত্যুর পূর্ব অব্দি হুমায়ূন আহমেদের লেখা, নাটক, গান, চলচ্চিত্র দুই বাংলার মানুষের নিত্য অনুষঙ্গের মতো ছিল। কাজের ক্ষেত্রে খুবই খুঁতখুতে ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তাইতো জনপ্রিয়তায় চূড়ায় থেকেও লেখার মান নিয়ে কখনো আপোষ করেন নি। তার পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের সবসময়ই অমৃতের স্বাদ বিভিন্নভাবে আপ্যায়ন করে গেছেন।

বেঁচে থাকা অবস্থায় নাকি মানুষের সৃষ্টি-কর্ম এমনকি খোদ মানুষটির ও মূল্যায়ন খুব একটা হয় না। হুমায়ূন আহমেদের মতো ক্ষণজন্মা মানুষ বোধ করি খুব কমই আছেন, জন্ম কিংবা মৃত্যুর জোয়ার ভাটা তার জনপ্রিয়তায় আঁচড় কাটতে পারি নি। নব্বইয়ের দশকের প্রজন্মের কাছে লেখক পরিচয় ছাপিয়ে নাট্য পরিচালকের পরিচয়টাই অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং সেটা অবশ্যই ‘আজ রবিবার’ এর মত কালজয়ী নাটকের কল্যাণে। তার আগেও হুমায়ূন আহমেদের অনবদ্য সব সৃষ্টি (এইসব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই) তে উঠে আসা মধ্যবিত্ত যাপিত জীবনের আটপৌরে অনুষঙ্গ আপনার প্রতি শুধুই ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা বাড়িয়েছে। আলী যাকের, ডা. এজাজুল, জাহিদ হাসানদের মতো শিল্পীদের অভিনয়টাকে ভিন্নমাত্রিক রূপ দেয়াই ছিল আপনার জাদুকরী সৃজনশীলতা। বাংলা নাটকের ইতিহাসে লিজেন্ডারি চরিত্র ‘বাকের ভাইয়ের’ জনপ্রিয়তা এখনো আকাশচুম্বি এবং তা শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছে বাংলা কথাসাহিত্যের এ অমর যাদুকরের সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায়। বাংলা নাটকের ইতিহাসে হাতেগোনা সেরা কয়েকটি চরিত্র নির্বাচন করলে ‘বাকের ভাই’ বোধ করি প্রথম দিকেই স্থান করে নিবে স্বমহিমায়। ভাবা যায় একটা নাটকে নাট্যকারের খেয়ালিপনায় বাকের ভাই চরিত্রের ফাঁসির আদেশ দর্শকের মনে কতোখানি দাগ কাটলে ছেলে বুড়ো থেকে শুধু করে আলেম সমাজকে পর্যন্ত রাস্তায় নামায়, বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ রোধ করার জন্যে!

বছর সাতেক আগে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের জোরারগঞ্জে বিজয় মেলায় আসাদুজ্জামান নূর বিশেষ অতিথি হয়ে এসেছিলেন। ছেলে আর বুড়োদের কথা বাদই দিলাম, শুধুমাত্র বাকের ভাইকে এক নজর দেখার জন্যে ডিসেম্বরের সে হাড়কাঁপা শীত উপেক্ষা করে মধ্য বয়স্কা থেকে বয়সের ভারে ন্যুজ্ব থুরথুরে বৃদ্ধাদেরও ভিড় লেগে গিয়েছিল। বাস্তবিক পক্ষে, এটাই হলো হুমায়ূন আহমেদ! এটাই হল তার অনবদ্য সৃষ্টির নমুনা!

বাংলা কথাসাহিত্যের এ যাদুকর উপন্যাসেও মায়াজাল বুনেছিলেন পাঠক সমাজের জন্য। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন-এ প্রত্যেকটি যেন লেখক হুমায়ূনের কিংবদন্তি হওয়ার এক একটি নিখুঁত অনুষঙ্গ।

বিংশ শতকের বাংলা উপন্যাসের কালজয়ী দুটি চরিত্র ‘হিমু আর মিসির আলী’র মধ্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে পাঠক হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন হুমায়ূন আহমেদ। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করা অদ্ভুত এক চরিত্র হিমু।

হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বিহান রাতে খালি পায়ে উষ্কখুষ্ক লম্বা চুলে আনমনে পিচ ঢালা রাস্তায় হেঁটে চলাই ছিল হিমু’র বেখেয়ালি সহজাত স্বভাব। মাঝে মাঝে নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করে আশপাশের মানুষজনকে চমকে দেয়া ছিল তার অদ্ভুত এক গুণ। এদেশের লাখ লাখ তরুণ নিজের গহীনে একটা করে হিমু চরিত্র পুষে রাখে। যান্ত্রিকতার চাপে পিষ্ট, ইট কাঠের এই শহরটাতে রোজ স্বপ্নভঙ্গের পর আবারো স্বপ্নবাজ হয়ে প্রতিটি তরুণ হিমু হতে চায়। কখনো কর্মস্থলে ঊর্ধ্বতনের ঝাড়ি খেয়ে এক কোণে বসে মন খারাপের হিসেব কষা কিংবা কখনো ভালোবাসার মানুষটার সাথে ঝগড়া শেষে আনাড়ী হাতে সিগারেট ফুঁকতে থাকা মানুষগুলো খুব করে চায় একটা দিনের জন্য হলেও হিমু হয়ে বাঁচতে। যার সকালে উঠে অফিসে যাওয়ার তাড়া থাকবে না, ঊর্ধ্বতনের ঝাড়ির তোয়াক্কা না করে চাকরিকে বুড়ো আঙুল দেখাবে। প্রেমিকার ফোন কল রিসিভ করার মতো কাজ ও যার কাছে তুচ্ছ মনে হবে। শুধুমাত্র হুমায়ুন আহমেদের পক্ষেই সম্ভব এমন একটি পরম ভালোবাসার অমর সৃষ্টি বইয়ের পাতায় জীবন্ত করে তোলা।

হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট রহস্যমানব ‘মিসির আলী’, চরিত্রের বিচারে হিমুর চেয়ে অনেকটা আলাদা ধাঁচের এই মানুষটি। উনার কাহিনীগুলোর মতো উনি নিজেও রহস্যময়তার আবেশে পাঠকদের আচ্ছন্ন করে রাখেন। মিসির আলী’র ঘটনাবলী ঠিক রোমাঞ্চকর  নয় বরং রহস্যে ঘেরা মনস্তাত্ত্বিক ধাঁচের। লেখক হুমায়ূন ‘মিসির আলী’ চরিত্র নিয়ে মনস্তত্ত্বে যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। আর যুক্তি দিয়েই উনার সব রহস্য উদঘাটিত হয়। কাহিনীর প্রতিটি পরতে থাকত অদ্ভুত সব ওঠানামা। পাঠককে কীভাবে কাহিনীর ভিতর দিয়ে হাঁটাতে হয় সেটা হুমায়ূন স্যার সুনিপুণ দক্ষতায় বছরের পর বছর তার বোনা চরিত্রাবলীর মধ্য দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন। নিজেদের যাপিত মধ্যবিত্ত জীবনটাকে কখনোই এতোটা অনাবিল আনন্দদায়ক আর রোমাঞ্চবেষ্টিত মনে হয়নি যতোটা তার লেখায় আবিষ্কার করেছে মধ্যবিত্ত পাঠকসমাজ। আলু ভাজি, ভর্তা, ডিমের চচ্চড়ির মতো খাবার ও তার কলমের ছোঁয়ায় স্বর্গীয় অমৃত ভেবেই গ্রোগাসে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে পাঠক সমাজ। ছোট ছোট কথায় এতো ভারী আর কঠিন জীবনদর্শন কীভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব, তার ব্যাখ্যা আমার মতো অনেক পাঠকই হয়ত খুঁজে পান নি অদ্যবদি। মধ্যবিত্ত মানুষগুলোকে আপনার মতো করে কেউ কখনো কাছ থেকে দেখেনি, কান পেতে শুনতে চায় নি তাদের বুকের ভেতর চলতে থাকা নীরব স্নায়ুযুদ্ধ। হুমায়ুন আহমেদ প্রায়শই নুহাশ পল্লীতে থাকা অবস্থায় গাছেদের সাথে কথা বলতেন। আপনার অবোধ পাঠক হিসেবে আমারও খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে-গাছ-ফুল-প্রজাপতি-প্রকৃতি এরা সবাই আপনার সুখ দুঃখের সব ভাষা বুুুঝতে পারতো।

হুমায়ূন আহমেদের পরিচালিত চলচ্চিত্রও ছিল তার মতো অনন্য। আগুনের পরশমনি, শ্যামল ছায়া, আমার আছে জল, নয় নম্বর বিপদ সংকেত -এ সব ক’টিই কালের মানচিত্রে রেখাপাত করেছে বৈকি! চল্লিশটির মতো গান ও সুর করছেন আপনি! এক যে ছিল সোনার কন্যা, আমার উড়াল পঙ্খী, চান্নী পসর রাইতে, যদি মন কাঁদে -এসব গানের আবেদন কখনোই ফুরাবার নয়।

যতোদিন এদেশের তরুণ যুবা বাউণ্ডেুলে জীবনের ছোট ছোট দুঃখ সুখের পসরা সাজিয়ে রাত বিরাতে চাঁদের আলোতে স্বপ্নের বিকিকিনি করবে, ততোদিন আপনি থাকবেন। যতোদিন বাঙালি মায়েদের হোঁসেলে নুন-মরিচ-সরিষা বাটা এসব অনুষঙ্গ থাকবে, ততোদিন মায়েদের ধোঁয়া ওঠা রান্নার পাতে আপনি বেঁচে থাকবেন।যতোদিন বাঙালি মেয়েদের মেঘবরণ গায়ের বর্ণচ্ছটা কিংবা দীঘলকালো খোলাচুলে খুঁজে পাবে নিজের প্রেয়সীকে তখন ফিসফিসিয়ে কানের কাছেই কেউ একজন বলে উঠবে-এহেন ভালোবাসা তো আপনিই শিখিয়েছিলেন স্যার।

আপনার লেখা নিয়ে অনেক এলিট ক্লাসের সাহিত্য সমালোচকরা নাক সিঁটকায়। এসব নিয়ে জীবদ্দশায় ও হুমায়ূন আহমেদ কখনো ভাবেন নি। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মতো সাধারণ শ্রেণীর পাঠকদের লেখক।যাদের ভালোবাসায় আর শ্রদ্ধায় তিনি সবসময় অসাধারণ হয়ে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেনও।

প্রাপ্তি কিংবা স্বীকৃতির আশায় হুমায়ূন আহমেদ কখনোই তাঁর ক্ষুরধার কলম চালান নি। তা সত্ত্বেও প্রাপ্তির খাতায় সে সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছিলেন বিভিন্ন পুরষ্কার ও সম্মাননা।আগুনের পরশমনি ও ঘেটু পুত্র কমলা চলচ্চিত্রের জন্য পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। শ্যামল ছায়া ও ঘেটু পুত্র কমলা বাংলাদেশ থেকে অস্কার যাত্রার জন্য চুড়ান্তভাবে মনোনীতও হয়েছিল। এছাড়া পেয়েছেন বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরষ্কার ও দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার একুশে পদক।

এতোসব প্রাপ্তির মাঝে আমাদের সবচেয়ে অপ্রাপ্তি প্রতিবছর একুশে বইমেলায় রঙিন মলাটে আপনাকে না পাওয়া।

শুভ জন্মদিন প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ।

ওপারে ভালো থাকবেন স্যার।

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট