গভীর মানবিক সংকটে ফিলিস্তিনের গাজা। ইসরায়েলি হামলার কাছে শরণার্থী শিবিরগুলোও ছাড় পাচ্ছে না। আর এসব হামলায় বেসামরিক নাগরিক নিহত হচ্ছেন, এদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
প্রায় মাসব্যাপী চলমান হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধে খাদ্য, পানি, বাসস্থান ও বিদ্যুৎ সংকটে জীবন বিপর্যস্ত সেখানে।
খাদ্য-পানির অভাবে জর্জরিত মানুষগুলোর শুকনো রুটিই আহারের একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু দুই রুটিতেই দিন যাচ্ছে বেশিরভাগ গাজাবাসীর।
গাজার জন্য জাতিসংঘ সংস্থার পরিচালক থমাস হোয়াইট শুক্রবার (৩ নভেম্বর) ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের করুণ পরিস্থিতির কথা এভাবেই সামনে আনলেন তিনি।
ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের জন্য জাতিসংঘের এ শীর্ষ সহায়তা কর্মকর্তা বলেছেন, গাজায় ফিলিস্তিনিরা জাতিসংঘের মজুদকৃত ময়দা থেকে তৈরি দুই টুকরো আরবি রুটির ওপর জীবনযাপন করছে। রাস্তায় এখন গাড়ি থামালে শোনা যাচ্ছে ‘ পানি পানি’ চিৎকার।
গত কয়েক সপ্তাহে গোটা গাজা অঞ্চল চষে বেরিয়েছেন থমাস হোয়াইট। গাজাকে ‘মৃত্যু ও ধ্বংসের দৃশ্য’ হিসাবে বর্ণনা করে তিনি বলেছেন, এখানে বর্তমানে কোনো জায়গা নিরাপদ নয়। লোকেরা তাদের জীবন, তাদের ভবিষ্যৎ এবং তাদের পরিবারকে খাওয়ানোর সক্ষমতা নিয়ে ভয় পাচ্ছে।
এক ভিডিও ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশের কূটনীতিকদের হোয়াইট বলেন, ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ গাজাজুড়ে প্রায় ৮৯টি বেকারিকে সহায়তা করছে। যার লক্ষ্য ১৭ লাখ লোককে রুটি দেওয়া। তবে মানুষ এখন রুটি খোঁজার আগে পানি সংগ্রহ করতে মরিয়া।
গাজায় পানি সংকটের অন্যতম কারণ সেখানে একটি মাত্র সুপেয় পানির লাইন চালু রয়েছে।
এ বিষয়ে জাতিসংঘের ডেপুটি মিডইস্ট সমন্বয়কারী লিন হেস্টিংস বলেছেন, দখলদার ইসরায়েল থেকে আসা তিনটি পানি সরবরাহ লাইনের মধ্যে মাত্র একটি চালু রয়েছে। পানির অভাবে অনেক মানুষ সমুদ্রের লোনা পানি ও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করছেন।
এসব সংকট নিরসনে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবিক প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস।
ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, গাজায় জ্বালানি প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে ইসরায়েল, মিশর, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের কর্তৃপক্ষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
জাতিসংঘের শীর্ষ কর্তা হেস্টিংস জানান, হাসপাতালে, পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট, খাদ্য উৎপাদন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো পরিচালনা করতে জেনারেটর দরকার। কিন্তু জ্বালানি সরবরাহ ফুরিয়ে যাওয়ায় একের পর এক জেনারেটর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
শরণার্থী শিবিরগুলোতেও মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারছেন না গাজাবাসী।
হেস্টিং বলেন, গাজায় গড়ে ৪ হাজর বাস্তুচ্যুত মানুষ পয়োনিষ্কাশনের সুবিধা ছাড়াই স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ। মহিলা এবং শিশুরা ক্লাসরুমে এবং পুরুষরা বাইরে খোলা জায়গায় ঘুমাচ্ছে।
ইসরায়েলের বোমা হামলার শঙ্কা মাথায় নিয়েই এভাবে রাত্রি যাপন করছেন তারা।
এ বিষয়ে জাতিসংঘের শীর্ষ সহায়তা কর্মকর্তা থমাস হোয়াইট বলেন, জাতিসংঘ গাজীবাসীর নিরাপত্তা দিতে পারে না। ইসরায়েলি বাহিনীর পাঁচটি সরাসরি আঘাত ইউএনআরডব্লিউএ’র ৫০টির মতো সুবিধাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। শেষ গণনায়, আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৮ জন মারা গেছেন। আমি আশঙ্কা করছি, এই মুহূর্তে উত্তরে লড়াই চলছে এবং এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে চলেছে। ।
মানবাধিকারপ্রধান গ্রিফিথস বলেছেন, গাজাবাসীর সেবা দিতে গিয়ে গত ৭ অক্টোবর থেকে ইউএনআরডব্লিউএ’র ৭২ জন কর্মী নিহত হয়েছেন। আমি মনে করি জাতিসংঘের কর্মীদের নিহতের এই সংখ্যা যে কোনো সংঘাতের মধ্যে সর্বোচ্চ।
জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তার ব্রিফিংয়ে দৃশ্যত যে, শরণার্থী শিবিরগুলোতে মৌলিক চাহিদা ও পর্যাপ্ত পানির অভাবে কাতরাচ্ছে মানুষ। শিবিরে নেই কোনো পয়োনিষ্কাশন সুব্যবস্থা।
কুর্দি নিউজ আউটলেট রুদাও জাতিসংঘ শিবিরে আশ্রয় নেওয়া বেশ কয়েকজন শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন।
উত্তর গাজা থেকে আসা বাসিন্দা ফাতিমা রাদওয়ান বলেছেন, ‘আমাদের অবস্থা খুবই গুরুতর। এখানে পানি নেই। বিদ্যুৎ নেই। শিশু ও বয়স্কদের যত্ন নেওয়ার কোনো জায়গাও নেই। এমনকি টয়লেটে যাওয়ার জন্য দীর্ঘ দূরত্ব হেঁটে ফের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে। ’
গাজার বাস্তুচ্যুত বাসিন্দা ইসমাইল আল-জাবালি বলেছেন, ‘আমরা পানির বোতল কিনতে বাধ্য হচ্ছি। টয়লেটে যেতে আমাদের সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করতে হয়। ’
আসমা আল-ওস্তাদ বলেন, বর্তমানে আমরা কঠিনভাবে জীবন পার করছি। এখানে কোনো বসার বা শোয়ার গদি নেই, আমরা প্লাস্টিকের ব্যাগে মাথা রেখে ঘুমাই। দিনের বেলা তাঁবুগুলো খুব গরম থাকে। রাতে আমরা খুব ঠান্ডা অনুভব করি। কারণ আমরা মাটিতে ঘুমাই। আর তাঁবুগুলোর গন্ধও বাজে, কারণ সেগুলো পুরোনো। আমরা আমাদের বাড়িতে ফিরতে চাই, কারণ আমরা ক্লান্ত।’
সূত্র: এপি
পূর্বকোণ/এএইচ