দামি ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো নষ্ট হয়ে গেলে, কিংবা এর কোনোও পার্টস ডিস্টার্ব দিলে চট করে পণ্যটি বাতিল করে দিতে ক’জনেরই বা হিম্মত হয়! এক্ষেত্রে বিকল্প একমাত্র উপায়টি হলো- সেটার রিপেয়ার বা মেরামত করানো। কিন্তু তাতেও সমস্যা রয়ে গেছে- সুদক্ষ কারিগর পাওয়া, উপযুক্ত খুচরা যন্ত্রাংশ পাওয়া এবং সর্বোপরি যুতসই রিপেয়ারিং মেশিনের। এসব পাওয়া গেলেও- অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ডিভাইসটির নির্মাতা কোম্পানিটির তরফে এতে দেয়া থাকে জটিল কোড বা অন্য কোনোও আইনি নিষেধাজ্ঞাও। ফলে রিপেয়ার সম্ভব হয় না। অগত্যা নতুন ডিভাইসেই যেতে হয়। অথচ তুলনামূলক কম খরচে রিপেয়ারটি করা গেলে ভোক্তা ডিভাইসটি আরো কিছুদিন অনায়াসে ব্যবহার করতে পারতেন। ডিভাইস ব্যবহার করে ভোক্তা প্রযুক্তির সুবিধা পাচ্ছেন, সন্দেহ নেই, কিন্তু সেটা তার জন্য আয়াসসাধ্য হচ্ছে না সেটাও ঠিক। পণ্যের বাজারে ‘ভোক্তার সুবিধা’ এড়িয়ে যাবার সুযোগ তাই নির্মাতাদের না নেয়াই উচিত। ভোক্তাদের, তাদের ডিভাইস মেরামত করার জন্য আরও ক্ষমতা (অধিকার) দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ- উভয় অঞ্চলেই নতুন আইন চালু করা হয়েছে। আমার করা হয়েছে, এটি প্রযুক্তি শিল্পের প্রকৃতিতে পরিবর্তন আনবে। আশা করা হয়েছে – এটি ডিভাইসগুলি দীর্ঘস্থায়ী করতে সহায়তা করে এমন প্রযুক্তির পরিবেশগত প্রভাব কমাতে সাহায্য করতে পারে এবং এটি আমাদের কেনা পণ্যের গুণমান উন্নত করতেও অবদান রাখতে পারে।
পাশাপাশি আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, এটি কেবলমাত্র ভোক্তাদের কাছে ব্যয়বহুল ‘মেরামত কিট’ এবং ‘খুচরা যন্ত্রাংশ বিক্রি’ করার সময় নির্মাতাদের দাম বাড়ানোর একটি উপায়ও হয়ে উঠতে পারে।
আমরা যখন কোনো পণ্য ক্রয় করি, তখন তার ওপর আমাদের পূর্ণ স্বত্ব থাকে। আমরা এটা পুরোপুরি ব্যবহার করতে চাই। ধরেন, আপনি একটি আইফোন কিনলেন। এ ফোনে আপনার স্বত্ব আছে। আপনি চাইলে এটা কাউকে দান, উপহার কিংবা বিক্রয় করতে পারেন। এটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। আপনি যে আইফোন ক্রয় করলেন, এটি নষ্ট হলে কিন্তু আপনি যেখানে ইচ্ছা সেখানে মেরামত করতে পারবেন না। আপনাকে অ্যাপল স্টোরেই এটাকে মেরামত করতে হবে এবং এ মেরামত অনেক ব্যয়বহুল। শুধু মেরামত নয়, অনেক সময় আনুষঙ্গিক পণ্যও সেখান থেকে কিনতে হয়। আপনাকে শুধু অ্যাপলের ফোন কিনলেই হবে না, অ্যাপলের চার্জার, ব্যাটারি, ইয়ার ফোন- সবই আপনাকে একই কোম্পানি থেকে কিনতে হবে। দেখা গেল, শুধু মূল পণ্যটিও নয়, আনুষঙ্গিক পণ্যও সেই কোম্পানি থেকে কিনতে হয়। ফলে অনেকে মেরামতের ব্যয় বহন করতে না পেরে ফোনটিকে অকেজো করে দেয়। এমনও হয়েছে, মেরামতের খরচ ও নতুন কোনো গ্যাজেট কেনার খরচ সমান হয়ে যায়। মেরামতের ব্যাপারে ব্র্যান্ডগুলোর এ অবস্থান ভোক্তাদের প্রতি একধরনের ‘মনোপলি’ আচরণ। এ ব্যবস্থায় কয়েক ব্যক্তি অথবা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মিলে বাজারের পণ্য বা সেবার মান নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে বাজারের স্বাভাবিক সরবরাহকে বিঘিœত করে বাজারের চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য নষ্ট করে।
সাধারণত, প্রতি দুই বছরে আমরা একটি নতুন পণ্য কিনি, এবং শিল্পের উৎপাদন টার্গেটও করা হয় এই ধরনের মডেলের উপর ভিত্তি করে। ইউরোপিয়ান এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির একটি রিপোর্ট অনুসারে, আমাদের বাড়িতে অনেক ইলেকট্রনিক পণ্য- টেলিভিশন থেকে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার- সেগুলোর ডিজাইন করা বা কাক্সিক্ষত আয়ুষ্কালের চেয়ে গড়ে ২-৩ বছর কম ব্যবহৃত হয়। আবার ভোক্তা নতুন মডেল কিনতে উৎসাহিত হয়, অথবা হার্ডওয়্যার আপডেট করা সফটওয়্যারের সাথে বেমানান হয়ে যায়- এসব কারণেও অনেক পণ্য বাতিলের খাতায় চলে যায়। কিছু নির্মাতা আবার পুরানো ডিভাইসগুলিতে চলমান সফটওয়্যারগুলির জন্য সুরক্ষা আপডেটগুলি প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয়। এসবের অবশ্যম্ভাবী ফল- পরিবেশে ইলেকট্রনিক বর্জ্যের বৃদ্ধি। ২০২০-এ আনুমানিক ৫৩ মিলিয়ন টন ইলেকট্রনিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছিল।
১৯৯০-এর দশকে, ইউরোপীয় আইন ন্যূনতম দুই বছরের গ্যারান্টি সময়কাল প্রবর্তন করেছিল, সেই সময়ে যে কোনও ইলেকট্রনিক আইটেমের ক্রেতার সম্পূর্ণ নতুন পণ্য পাওয়া বা কিছু ভুল হলে তাদের বিদ্যমান পণ্যটি মেরামত করার মধ্যে বেছে নেওয়ার অধিকার ছিল। আংশিকভাবে, ন্যূনতম-গ্যারান্টি আইনটি ২০ শতকের প্রথম দিক থেকে নির্মাতাদের তাদের পণ্যের জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ লিখে রাখায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।
তাছাড়া কোম্পানিগুলো তাদের ডিভাইসগুলোতে সফটওয়্যারের এমন জটিল কম্বিনেশন রাখছেন ইদানীং যে, সেগুলোর মেরামতির সুযোগ থাকে সত্যিকার অর্থেই সীমিত। ফলে ‘আসক্ত’ ভোক্তার নতুন আরেকটির দিকে ঝোঁকা ছাড়া গত্যন্তর থাকেনা।
আইনে অধিকার নিশ্চিত করা : ভোক্তাদের একটি পণ্যে আসক্ত করিয়ে, তার আনুষঙ্গিক পার্টসগুলোকে প্রায় তার নাগালের বাইরে রেখে (অত্যধিক দাম) কোম্পানিগুলো একধরনের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণই করে যাচ্ছে- যা ভোক্তা আইনের পরিপন্থী। কিন্তু প্রচলিত কোনোও আইনেই কোম্পানিগুলোর এ দৌরাত্ম্য রোখা যাচ্ছে না। মূলত, পরিবেশের ইকোসিস্টেমের কথা মাথায় রেখে ভোক্তাদের তাদের পণ্যের মেরামতির অধিকারের পক্ষে আইন ইত্যাদি করে সুফল আদায় করে নেয়া প্রথম অঞ্চল হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। তাদের আইনের ফলেই ১৯ ইউরোর লাইটনিং ক্যাবল চার্জারের পরিবর্তে আজ কোম্পানিগুলো সাধারণ ইউএসবি-সি চার্জার (১-২ ইউরো) রাখছে তাদের ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোয়। ইইউ’র নিয়মে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের জন্য সাধারণ চার্জার বাধ্যতামূলক করার প্রতিক্রিয়ায় এই পরিবর্তন করা শুরু হয়েছে। বড় বাজার হারাবার ভয়ে কোম্পানিগুলো এহেন ভোক্তা-বান্ধব আইনে সাড়া দিতে বাধ্য হয়েছে।
শুুধু তা-ই নয় ‘মেরামতের অধিকার’ বিষযক আইনটি আগামী বছরের শুরুর দিকে ইইউ-তে আইনে পরিণত হতে যাচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলো জনগণকে ইতোমধ্যে ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোর সৃষ্ট বর্জ্য সম্বন্ধে সচেতন করে তোলার প্রয়াস নিয়েছে। তারা মানুষকে আরো সচেতন হয়ে কেনার পূর্বেই ‘মেরামতযোগ্য’ পণ্যটি কিনতেই উৎসাহিত করতে চাইছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ‘মেরামতের অধিকার’ আইনটি ইতোমধ্যেই আইনে পরিণক হয়েছে। নিউ ইয়র্ক, কলোরাডো এবং মিনেসোটাও হাঁটছে একই পথে। নির্মাতা কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করা হচ্ছে তারা যেন তাদের পণ্যগুলো মেরামতযোগ্য করেই প্রস্তুত করে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সম্প্রতি মার্কিন ভোক্তাদের তাদের নিজস্ব ডিভাইস মেরামত করার অধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন – এমন একটি পদক্ষেপ যা নির্মাতাদের কাছ থেকে কিছুটা সমর্থন পেয়েছিল।
কীভাবে পণ্য পরিবর্তন হবে : বিশেষজ্ঞ মত হলো- পরিবর্তন অনিবার্য। তবে এখনো এটি একটি অনুমান মাত্র- ‘ভবিষ্যতের পণ্যগুলি কেমন হবে’। এটি নির্ভর করবে সমযের পরিবর্তনের সাথে সাথে ভোক্তার প্রয়োজনের উপর। মুঠোফোন, কম্পিউটার, ট্যাবলেটসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক গ্যাজেট তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে ভোক্তারা যাতে কম খরচে মেরামত করতে পারে, এ আইনের উদ্দেশ্য সেটাই। প্রস্তাবিত আইনে উৎপাদনকারীরা বাধ্য থাকবেন পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার সব তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করতে। ফলে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ও তৃতীয় পক্ষের মধ্যে ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটবে, যা মূলত ভোক্তাকে লাভবান করবে। এ ছাড়া এ আইনে মেয়াদোত্তীর্ণ ইলেকট্রনিক গ্যাজেট মেরামত করে পুনরায় ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে। বর্তমানে একটা নির্দিষ্ট সময় পর উৎপাদিত কোম্পানিগুলো পুরোনো কোনো পণ্য মেরামত করে দিতে চায় না। বরং তাদের উৎপাদিত নতুন পণ্য বাজারজাত করতে বেশি আগ্রহী। মেরামতের অধিকার দেওয়া হলে একই জিনিস মেরামত করে অনেক দিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে।
উৎপাদক কোম্পানিগুলো খুব সহজে মেরামতের অধিকার দিতে রাজি হবে না। তারা চাইবে না তাদের উৎপাদিত পণ্য অন্য কোথাও মেরামত করা হোক। এ জন্য তাদের বড় হাতিয়ার কপিরাইট আইন, ট্রেডমার্ক ও পেটেন্ট আইন। এ ছাড়া মেরামতের অধিকার ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি ল বা বুদ্ধিবৃত্তিক আইনের সঙ্গেও কিছুটা সাংঘর্ষিক। কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারেন, মেরামত বা আংশিক পুনরুৎপাদনের সুযোগ দেওয়া হলে প্রযুক্তির গোপনীয়তা বলে কিছু থাকবে না। এখানে মেধাস্বত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে নতুন নতুন গবেষণা ও আবিষ্কারে আগ্রহ কমে যাবে।
বাস্তবতা হলো, মেরামতের অধিকার পরিবেশ রক্ষার জন্য খুব জরুরি। একই পণ্য বারবার মেরামত করার সুযোগ থাকলে তা অনেক দিন ধরে ব্যবহার করা যায়। ফলে গ্রাহক সহজে নতুন কোনো পণ্য কিনবেন না। ফলে ইলেকট্রনিক বর্জ্য তৈরির আশঙ্কা অনেক কমে যায়। এতে পরিবেশদূষণ অনেক কমে যাবে।
এটা ঠিক, মেরামতের অধিকারের ধারণা তুলনামূলকভাবে নতুন। তবে ভোক্তার অধিকার ও পরিবেশ রক্ষার প্রেক্ষাপটে মেরামতের অধিকার অদূর ভবিষ্যতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সামনে আসবে। স্বল্পোন্নত দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর এতে প্রযুক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তবে নিশ্চিতভাবেই, যে প্রযুক্তি, হার্ডওয়্যার এবং গৃহস্থালীর যন্ত্রপাতিগুলিতে তারা যে পরিমাণ ব্যয় করছে তার সাথে ভোক্তাদের অধিকার রয়েছে তা নিশ্চিত করতে আরও দীর্ঘ পথ যেতে হবে। [সূত্র : বিবিসি]
পূর্বকোণ/আরডি