চট্টগ্রাম রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাংলাদেশকে সাফ জেতানো কোচের মৃত্যু: এ দেশকে আপন করে নিয়েছিলেন কোটান

রাশেদুল ইসলাম

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | ৭:৩৬ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক কোচ জর্জ কোটান আর নেই। গত ২৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি। আগামী ৬ অক্টোবর হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে তাঁর অন্তোস্টিক্রিয়া। বিষয়টি হাঙ্গেরি ফুটবল ফেডারেশনের পক্ষে থেকে আমাকে নিশ্চিত করা হয়েছে।

একজন ফুটবল দর্শক হিসেবে বরাবরই কোচ জর্জ কোটানে মুগ্ধ ছিলাম। সেই ক্লাস সেভেন এ পড়া অবস্থা থেকে তাঁকে চেনা–জানা। ‘গ্রান্ড ফাদার’ বলে সম্বোধন করতাম। বিকেএসপিতে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তাঁর প্রাকটিস দেখা ছিল আমার নেশা।

কোটানের পরবর্তী সময়ে আসা সব বিদেশি কোচকেই ব্যক্তিগতভাবে ভালোভাবে জানি। বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দল মিলিয়ে কোন কোন কোচের অধীনে তো প্রাকটিস করারও সুযোগ হয়েছে। কিন্তু কোটানের মত বাংলাদেশকে আপন করে নিতে দেখেনি কাউকে। অন্যান্য কোচেরা বেশিরভাগই কাজ করেছেন শুধুমাত্র পেশাদারি জায়গা থেকে আর কোটান কাজ করেছেন বাংলাদেশকে ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখে।

শুধু জাতীয় দল নয়, আবাহনী লিমিটেডেরও কোচ ছিলেন কোটান। ২০১৬ সালে ফেডারেশন কাপে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরের দিনের গল্পটা এখনো আমার কাছে তরতাজা।

ভরদুপুরে আবাহনী ক্লাবটা তখনও ঘুমিয়ে। চার বছর পর ফেডারেশন কাপের শিরোপা জয়ের রেশমাত্র নেই। আগের দিনের জয় নিয়ে কারও সঙ্গে এক-আধটু খোশগল্প করবেন, এমন একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যায়নি ক্লাবে। নিচতলার বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে ফুটবল মাঠে একজন দীর্ঘদেহী মানুষকে দেখলাম। দূর থেকে স্পষ্ট চেনার উপায় নেই বলেই একটু কাছে গিয়ে দেখা। আরে, ইনি তো কোচ জর্জ কোটান!

চৈত্রের দুপুরে সূর্যটা তখন মাথার ওপরে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রখর রৌদ্রের মধ্যে নিজেই মেশিন ঠেলে ঠেলে ঘাস কেটে যাচ্ছেন ‘বুড়ো’ লোকটি। ফুটবলারদের ফুটবল পাঠ শেখানো ছাড়াও মাঠের ঘাস লাগানো আর সময়মত ঘাস ছেঁটে ছোট করাও ছিল তার কাজ।

তাই সবার মতো দুপুর পর্যন্ত ঘুমানোর ফুরসত যেন নেই ‘সব্যসাচী’ কোটানের! বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করা বার্সেলোনা, আয়াক্সের কিংবদন্তি কোচ রাইনাস মিশেলসের সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করা এ মানুষটি বিশ্বাস করতেন, ‘কোয়ালিটি ফুটবল ডিপেন্ডস কোয়ালিটি ফুটবল ফিল্ড!’

আবাহনী ক্লাবের মাঠে নিজের হাতে পানি দিয়ে সার ছিটিয়েছেন, যেখানে ঘাস ছিল না সেখানে নতুন করে লাগিয়েছেন ঘাস; আবার সময়মত নিজের টাকায় তেল কিনে এনে তা ছাঁটাইও করেছেন। মাঠে যাতে কেউ প্রবেশ না করতে পারে, সে জন্য তৈরি করেছিলেন বেড়াও।

তিনি উপস্থিত থাকাকালীন মাঠে এসে কেউ বসতে চাইলে হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘এখানে নয়, ধানমন্ডি লেকে গিয়ে বাদাম কিনে খাও আর আড্ডা দাও!’

মাঠের পরিচর্যার পাশাপাশি রান্নাঘরের পরিবেশের তদারকিও ছিল তাঁর। খাওয়ার প্লেটগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয়েছে কি-না বা খেলোয়াড়দের মানসম্মত খাবার দেওয়া হচ্ছে কি-না সব দায়িত্বই নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে।

অথচ বাংলাদেশকে ২০০৩ সালে সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ উপহার দিয়েও তাঁর বিদায়টা হয়েছিল খুবই বাজে। তাঁর বিদায়ে জাতীয় দল হারিয়েছিল বাংলাদেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় একজন শুভাকাঙ্ক্ষীকেও।

অস্ট্রিয়ায় ফিরে গিয়ে নিজের বাড়ির দেয়ালে টানিয়ে রেখেছিলেন বাংলাদেশের পতাকা। এত দিনে দেয়ালে টানানো লাল-সবুজ রঙ মলিন হলেও তার মনে তরতাজা ছিল বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের ফুটবলে ইউরো, ডলার , পাউন্ডে অনেক বিদেশি কোচই এসেছেন। তবে ‘কোটান’ হতে পারেননি কেউ। না সাফল্যে বিচারে, না লাল – সবুজের প্রতি আন্তরিকতা ও ভালোবাসায়। ভালো থাকবেন মাই গ্রান্ডফাদার। ভালো থাকবেন ‘ দ্যা সাকসেসফুল ফেস অফ বাংলাদেশ ফুটবল’

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন