চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

অবৈধ লেনদেনে গতিহারা দলে নতুন মেরুকরণ!

দক্ষিণ জেলা বিএনপি

মোহাম্মদ আলী

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | ১২:০৬ অপরাহ্ণ

অবৈধ লেনদেনে গতিহারা দক্ষিণ জেলা বিএনপি। সৃষ্টি হচ্ছে নেতৃত্বে নতুন মেরুকরণও। নতুন কমিটি গঠনে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠায় দলের মধ্যে এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। দলের এ সমস্যায় নতুন করে ‘ঘি’ ঢেলে দিয়েছে বিএনপি’র একাংশের একটি বৈঠক। দক্ষিণ জেলা বিএনপির বর্তমান ও সাবেক নেতৃত্বের একাংশকে নিয়ে এ বৈঠক হয় বলে জানা গেছে। পটিয়ার সাবেক এমপি গাজী শাহজাহান জুয়েলের নগরীর বাসায় গতকাল (শনিবার) বিকেলে এ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।

 

এদিকে ‘বিকাশ নেতার বিকাশ কমিটি’- এ অপবাদ যেন পিছু ছাড়ছে না দক্ষিণ জেলা বিএনপি কিংবা অঙ্গ সংগঠনের। কমিটি ঘোষণার পরপরই প্রতিবাদ সমাবেশ করে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলছেন পদবঞ্চিতরা। একই সাথে অভিযোগ তুলছেন টাকা দিয়ে পদ ভাগিয়ে নেওয়ারও। এ নিয়ে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীর মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।

 

উত্তর, দক্ষিণ ও মহানগর নিয়ে চট্টগ্রামে বিএনপির তিন সাংগঠনিক কমিটি রয়েছে। উত্তর ও মহানগরে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের কমিটি ঘোষণার পর পদবঞ্চিতদের অসন্তোষ থাকলেও দক্ষিণ জেলায় ক্ষোভ বাড়ে আরো বেশি। সাংগঠনিক এ জেলায় পদবন্টনে আর্থিক লেনদেনের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠে নেতাদের বিরুদ্ধে। দিনদিন এ দাবি আরো জোরালো হচ্ছে। বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলসহ সব অঙ্গসংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে এ দাবি উঠছে। তবে মহানগর ও উত্তর চট্টগ্রামে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনের গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ তেমন একটা উঠেনি।

 

দক্ষিণ জেলায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন কমিটির পদবঞ্চিতদের অভিযোগ, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে কোন কোন নেতা অবৈধ সুবিধা নেন তা দিবালোকের মত স্পষ্ট। বেশিভাগ নেতাকর্মীর মুখে মুখে তাদের নাম শোনা যায়। এই অর্থলোভী নেতারা আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো অযোগ্যদের জন্য ভাগিয়ে নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুযায়ী পদ পাচ্ছেন না দলের দুঃসময়ের ত্যাগী নেতারা। আবার অনেকে মূল পদ দূরের কথা কমিটির কোন পদই পাচ্ছেন না। কেন্দ্রীয় বিএনপির এক নেতা ও দক্ষিণ জেলার এক নেতা এই আর্থিক লেনদেনের সুবিধা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। তাতে ক্ষোভের অনলে পুড়ছেন পদবঞ্চিতরা।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক নেতা বলেন, দলের দুর্গ হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ চট্টগ্রামের ছয়টি সংসদীয় আসনের সবকটি নির্বাচনে বিএনপির আধিপত্য ছিল সবচেয়ে বেশি। অতীতে বাঘা বাঘা নেতারা দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এলডিপি গঠনের আগে কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রমের নেতৃত্বে দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিএনপির শক্ত অবস্থান তৈরি হয়। এছাড়া দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিএনপিকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে ব্যাপক অবদান রাখেন সাবেক মন্ত্রী এম মোরশেদ খান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, এডভোকেট আহমদুর রহমান চৌধুরী, আবু ছালেহ চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, আহমদ খলিল খান, গাজী শাহজাহান জুয়েল, সরওয়ার জামাল নিজাম, শাহ নেওয়াজ মন্টু, এডভোকেট কবির চৌধুরী, আনোয়ারুল হক কাদেরী, আবদুর রহিমসহ আরো অনেকে। কিন্তু অতীতে বিএনপি কিংবা অঙ্গসংগঠনের কমিটি গঠনে নেতাদের বিরুদ্ধে অনৈতিকভাবে আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে কোন অভিযোগ উঠেনি। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে কোন কমিটি ঘোষণা হলেই আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি সামনে চলে আসছে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে সভা, ঝাড়– মিছিলসহ বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ করছেন পদবঞ্চিতরা।

 

এদিকে বর্তমানে দক্ষিণ জেলা বিএনপির মূল নেতৃত্বে রয়েছেন আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম ও সদস্য সচিব মোস্তাক আহমেদ খান। ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর ৬৫ সদস্যের নতুন এ আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। সর্বশেষ গত ৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবদলের নয় উপজেলা ও পৌরসভার পূর্ণাঙ্গ এবং চার উপজেলা ও পৌরসভার আংশিক আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে জেলা কমিটি। এ কমিটি ঘোষণার পরপরই আবারো সামনে আসে অবৈধভাবে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি।

 

পদবঞ্চিতদের অভিযোগ, দক্ষিণ জেলা যুবদলের সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহান ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আজগর নতুন কমিটি ঘোষণার ক্ষেত্রে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করেননি। ঘোষিত এসব কমিটির বিরুদ্ধে তৃণমূল থেকে অনেক অভিযোগ ওঠে। যুবদল কমিটির আগে গত ১১ আগস্ট চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের ৪২ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় কমিটি। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান এবং সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলের স্বাক্ষরিত এই কমিটিতেও চাকরিজীবী, বিবাহিত, সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে জুনিয়রকে গুরুত্বপূর্ণ পদ প্রদানসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। এমনকি ঘোষিত কমিটির অনেকের ছাত্রত্বও নেই বলে জানা গেছে। এ নিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা পদবঞ্চিতরা দক্ষিণ জেলা বিএনপির কার্যালয়েও তালা মেরে দেয়। পদবঞ্চিতদের হামলার শিকার হন ছাত্রদলের নতুন কমিটির নেতারা।

 

এদিকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কমিটি গঠনে আর্থিক লেনদেনের গুরুতর অভিযোগের মধ্যে গতকাল গাজী শাহজাহান জুয়েলের নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা বি ব্লকের ১৪ নং রোডের ৬৪ নং বাসায় বিএনপি’র একাংশের  বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মোস্তাক আহমদ খান, জেলা বিএনপি’র সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আলী আব্বাস, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সিনিয়র সদস্য এডভোকেট ইফতেখার হোসেন চৌধুরী মহসিন, বদরুল খায়ের চৌধুরী, জামাল হোসেন, লায়ন হেলাল উদ্দিন, মোজাম্মেল হক, দক্ষিণ জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি শফিকুল ইসলাম চেয়ারম্যান, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি আলমগীর তালুকদার টিপু, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি সাইফুদ্দিন সালাম মিঠু, মো. গোলাম মহিউদ্দিন, জিল্লু রহমান,‌ জাহেদুল হক, ইউনুছ মিয়া চেয়ারম্যান, মুজিবুর রহমান, ইদ্রিস পানু, শফিকুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, আনোয়ার ইসলাম মিয়া, সাইফুল ইসলাম খোকন, জাহাঙ্গীর আলমসহ উপজেলা-পৌরসভা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের দুই শতাধিক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। দুই ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে নেতৃবৃন্দ বলেন, দক্ষিণ জেলা বিএনপিতে বর্তমানে নেতৃত্ব সংকট চলছে। দলের মধ্যে কোন শৃঙ্খলা নেই। জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর মৃত্যুর পর অভিভাবক হারা বিএনপি। এ অবস্থায় গাজী শাহজাহান জুয়েলকে দলের নেতৃত্ব গ্রহণের আহ্বান জানান নেতৃবৃন্দ।

 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘বিএনপি একটি বড় দল। এ দলে প্রতিযোগিতা রয়েছে। একটি পদের বিপরীতে কমপক্ষে ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে। তাই কমিটি ঘোষণার পর একটু প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক। তবে নতুন কমিটি ঘোষণার ক্ষেত্রে অবৈধভাবে আর্থিক লেনদেনের খবরেও বিব্রত হচ্ছি। এটি একেবারে মিথ্যা তাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।’

 

বিএনপি একাংশের বৈঠক প্রসঙ্গে আবু সুফিয়ান বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। কেউ আমাকে বলেননি।’

 

পূর্বকোণ/আরডি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট