সরকার পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ পরিবহন সেক্টর পরিচালনা করার কারণে এই সেক্টরে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা, ভাড়া নৈরাজ্য, যাত্রী হয়রানি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে বলে অভিযোগ যাত্রী কল্যাণ সমিতির।
বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে যাত্রী অধিকার দিবসের আলোচনা সভায় বক্তারা এই অভিযোগ করেন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত ‘সড়ক পরিবহন আইনে যাত্রীদের অধিকার চাই’ শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা আরো বলেন, যাত্রী সাধারণের সাথে সরকারের কার্যকর যোগাযোগের উপায় না থাকায়, নানানভাবে হয়রানির শিকার দেশের যাত্রীরা প্রতিকার পায় না। এতে দেশের যাত্রী সাধারণ অসহায় হয়ে পড়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেও এই সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যর্থ হওয়ায় নতুন সড়ক পরিবহন আইনের দাবি উঠে। নাগরিক সমাজের দাবির প্রেক্ষিতে নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাস হয়। নতুন সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-তে পরিবহন পরিচালনার ও যাত্রী সাধারণের সুযোগ সুবিধা প্রদানের নানাবিধ সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে যাত্রী সাধারণ তথা জনসাধারণের মতামত ও অংশগ্রহণের সুযোগ না রাখায় এই আইন বাস্তবায়নের দীর্ঘ ৪ বছরেও নতুন আইন ও পুরনো আইনের তেমন কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ সংগঠনটির। তাই এবারের যাত্রী অধিকার দিবসে ‘সড়ক পরিবহন আইনে যাত্রীদের অধিকার চাই’ এই দাবিকে সামনে আনা হয়েছে বলে দাবি করেন বক্তারা।
ক্রমবর্ধমান উন্নয়নশীল এ দেশে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ধারাবাহিকভাবে তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় যোগাযোগ সেক্টরের অবকাঠামো বিনির্মাণে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও সড়কে শৃংঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ততটা পিছিয়েছে বলে দাবি সংগঠনটির। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে প্রতিবছর সড়কে ২৪ হাজার ৯৫৪ জনের প্রাণহানি ঘটছে।
সভায় বক্তারা বলেন, দেশের যোগাযোগ সেক্টরে অবকাঠামো নির্মাণে লাখো কোটি টাকা ব্যয় হলেও রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের শহর ও শহরতলীতে যাতায়াতের জন্য মানসম্মত কোন গণপরিবহন নেই। রাজধানীতে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ভাঙা ছেঁড়া, লক্কড়-ঝক্কড় বাসে সাড়ে চার কোটি ট্রিপ যাত্রী অস্বাভাবিক ভোগান্তি নিয়ে লাখ লাখ নগরবাসী প্রতিদিন যাতায়াত করছে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আত্মসামাজিক অবস্থাসহ গড়-জিডিপিতেও এশিয়ার বহু দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও ঢাকায় গণমানুষের আরামদায়ক, স্বাছন্দময় যাতায়াতের কোন গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। অথচ বেসরকারি খাতে পরিচালিত আমাদের আন্তঃজেলা বাস সার্ভিসগুলো পৃথিবীর উন্নত বিশ্বের সাথে তুলনা করা যায় বলে দাবি করেন তারা।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকার বাসের ভাড়া নির্ধারণ করেন মালিকদের প্রেসক্রিপসন অনুযায়ী। অথচ আন্তর্জাতিক ক্রেতা ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ী বাস ভাড়া নির্ধারণ কমিটিতে বাস মালিকদের সংখ্যা অনুপাতে যাত্রী বা ভোক্তা প্রতিনিধি রাখার বিধান থাকলেও নতুন সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী বাস ভাড়া নির্ধারণ কমিটিতে মালিক-শ্রমিক সরকার মিলেমিশে ভাড়া নির্ধারণ করছে। এতে করে কখনো কখনো সরকার বাস মালিকদের পকেটে ঢুকে পরে ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই যাত্রী তথা জনস্বার্থে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ সংশোধন পূর্বক বাস ও গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ কমিটিতে বাস মালিকদের সংখ্যানুপাতে যাত্রী প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করার বিধান সংযুক্ত করার দাবি জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, বাসের রুট পারমিট তথা রুট অনুযায়ী বাসের সিলিং নির্ধারণ, ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ, বাসস্টপেজ নির্ধারণ, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় মনিটরিং কমিটি, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের আর্থিক সহায়তা তহবিল, বিআরটিএ, বিআরটিসি, সওজ, মেট্রোরেল পরিচালনা পর্ষদ, যাবতীয় টোল নির্ধারণ, পরিবহন আইন ও বিধি বিধান তৈরি ও সংশোধন, সংযোজনে, যাত্রী সাধারণের জন্য সুযোগ সুবিধা নির্ধারণের প্রতিটি কমিটিতে যাত্রী সাধারণের প্রতিনিধি রাখার বিষয়টি সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ তে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান তিনি।
সভায় অংশ নিয়ে ওয়ার্কাস পাটির সংসদ সদস্য লুৎফুন্নেছা খানম এমপি বলেন, যাত্রীদের ভোগান্তি লাঘবে আইনি সুরক্ষা প্রয়োজন অথচ সড়ক পরিবহন আইনে যাত্রী স্বার্থ চরমভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, আমরা দীঘদিন যাবৎ যাত্রী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার দাবি তুলছি। ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করছি। অথচ সরকার সড়ক পরিবহন আইনে যাত্রী সাধারণের মতামত ও অংশগ্রহণের সুযোগ রাখে নি।
সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মনজুরুল আলম পান্না, মানবাধিকার সংগঠক মনজুর হোসেন ইশা, যাত্রী কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি তাওহিদুল হক লিটন, মোহাম্মদ মহসিন প্রমুখ।
পূর্বকোণ/পিআর