চট্টগ্রাম শুধু বাণিজ্যিক রাজধানী নয়, ভৌগোলিকভাবে এই অঞ্চলে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার পরও তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে দীর্ঘসময় চট্টগ্রামে বড় বিনিয়োগ হয়নি। চট্টগ্রামের অবকাঠামো উন্নয়ন বলতে গত এক দশকের কথা বলতে হয়। এ সময় চট্টগ্রাম ঘিরে নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। লজিস্টিকস খাতের ব্যবসায়ী হিসেবে আমি ভবিষ্যৎ চট্টগ্রামের নতুন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।
গভীর সমুদ্রবন্দর না হওয়ার যে দীর্ঘ আক্ষেপ ছিল তা মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে পূরণ হতে যাচ্ছে। এই প্রকল্প ঘিরেই আমরা স্বপ্ন দেখছি। কারণ মাতারবাড়ী হবে এই অঞ্চলের সি বর্ণ ট্রেডের বড় হাব। আবার বে টার্মিনালও এই স্বপ্নকে আরও বড় করবে। এই দুটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে জাহাজ ভিড়ানোর জন্য আর জোয়ারের অপেক্ষা করতে হবে না। মাতারবাড়ী থেকে ইউরোপ-আমেরিকার সাথে সরাসরি কনটেইনার সার্ভিস চালু হবে।
বড় জাহাজে বিদেশ থেকে আনা পণ্য সাগর ও নৌপথে চট্টগ্রাম বন্দরের মূল জেটি, পায়রা ও মোংলায় সহজে পরিবহন করা সম্ভব হবে। বায়ারের হাতে গার্মেন্টস পণ্য তুলে দিতে সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া বা কলম্বোর ওপর নির্ভরতা কমবে। সরকার বন্দরকেন্দ্রিক এই দুটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও হিন্টারল্যান্ড উন্নত না করলে সুফল পাওয়া যাবে না। যেমন কর্ণফুলীতে যে টানেল হচ্ছে তা দিয়ে মাতারবাড়ী থেকে সারাদেশে পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে। তবে উপকূল ধরে মেরিন ড্রাইভ না করলে এই সুফল সহজে পাওয়া যাবে না। যতটুকু জানি, সরকার পরিকল্পনা করছে মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করার। এটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার।
চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে পণ্য পরিবহনে যাতে অভ্যন্তরীণ জাহাজে আরও বেশি পণ্য পরিবহন করা যায় সেজন্য নদীপথে ড্রেজিং করতে হবে। সড়কপথে বেশি পণ্য আনা-নেওয়া হয়। মাতারবাড়ী, বে-টার্মিনাল ও বন্দরের মূল জেটিতে যে কার্গো হ্যান্ডলিং হবে তার বড় অংশই যাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে সারাদেশে। কিন্তু চার লেনের সড়ক এই চাপ সামলাতে পারবে না। এজন্য আটলেনের সড়ক দরকার। তবে পণ্য পরিবহনের জন্য আলাদা সড়ক নির্মাণের সময় এসেছে। পণ্য পরিবহনের জন্য আরসিসি সড়ক নির্মাণ করা হলে এক গাড়িতে ৪০-৫০ টন পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে। তাতে জ্বালানিখরচ কমবে। পণ্য পরিবহন খরচও কমবে। এখন কথা হচ্ছে, গভীর সমুদ্রবন্দর, টানেলসহ পণ্য পরিবহনের যোগাযোগের যেসব অবকাঠামো গড়ে ওঠছে তার সুফল কীভাবে নেবো আমরা? প্রতিবেশী দেশগুলো যদি এসব সুবিধা ব্যবহার করে তাহলে এসব অবকাঠামোর ব্যবহার বাড়বে।
আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নতুন নতুন খাত যুক্ত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতে হয়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত এপ্রিলে ট্রানজিট সুবিধা নিয়মিত করার পর এখনো কোনো চালান যায়নি। কেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এই সুবিধা নিচ্ছে না তা দুই দেশের ব্যবসায়ীদের সাথে নিয়ে আলোচনা করা দরকার। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মাঝে ব্যাপক প্রচারণার উদ্দ্যোগ নেওয়া দরকার। নেপাল একসময় বন্দর ব্যবহার করলেও এখন করছে না। ট্রানজিট নিয়মিত হলে দুই দেশের লাভ হবে। নিয়মিত ট্রানজিটের চালান আনা-নেওয়া হলে শুধু সরকারের আয় হবে না, সবচেয়ে বড় সুফল পাবে বেসরকারি খাত। কারণ বেসরকারি খাতে আয় হবে বেশি। শিপিং, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং, ট্রান্সপোর্টসহ নানাখাতে আয় বাড়বে। মনে হয় যেসব অবকাঠামো হচ্ছে সেগুলোর কানেক্টিভিটি বাড়াতে না পারলে সুফল মিলবে না।
লেখক: খায়রুল আলম সুজন, সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স এসোসিয়েশন (বাফা) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন
পূর্বকোণ/সাফা/এএইচ