অনেক জল্পনা-কল্পনার পর সীতাকুণ্ড থানায় আটক করা ৪৫ টন সরকারি চাল ফেরত দেওয়া হয় ডিও ব্যবসায়ীকে। চালগুলো হালিশহর খাদ্য গুদাম থেকে খাগড়াছড়ির তবলছড়ি ও দিঘিনালা খাদ্য গুদামে যাওয়ার কথা ছিল। বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় ট্রাক তিনটি হালিশহর গুদাম থেকে বের হয়। শুক্রবার ভোর সকালে চালগুলো ফৌজদারহাটে চাল ব্যবসায়ী উমর ফারুকের গুদামে খালাসের সময় আটক করে পুলিশ।
সীতাকু- থানার ওসি তোফায়েল আহমদ পূর্বকোণকে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সংস্থার মতামতের ভিত্তিতে সোমবার চালগুলো ফেরত দেওয়া হয়।’
খাদ্য কর্মকর্তারা জানান, প্রোগ্রামের (চালের কর্মসূচি) চাল গুদাম থেকে গুদামে পৌঁছাবে। মাঝপথে ট্রাক নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা অবৈধ ও কালোবাজারি।
খাগড়াছড়ি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা রূপান্তর চাকমা পূর্বকোণকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শুধু তাই নয়, এভাবে প্রতিনিয়ত সরকারি চাল কালোবাজারে পাচার হয়ে আসছে। বার বার চাল ধরা পড়লেও সর্ষে ভূতের কারণে বেপরোয়া হয়ে উঠে কালোবাজারিরা। অভিযোগ রয়েছে, গুদাম ও খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চোরাকারবারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এতে বড় ধরনের ক্ষতি গুনতে হচ্ছে সরকারকে।
থামছে না কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য : গত বছরের ২৮ জুন নগরীর চাক্তাই রাজাখালীর মোশাররফ হোসেন রোডে সরকারি খাদ্যবান্ধব চাল পাচারকালে আটক করেছিল পুলিশ। চালগুলো হালিশহর খাদ্য গুদাম থেকে খাগড়াছড়ি খাদ্য গুদামে পৌঁছানোর কথা ছিল। মেসার্স বেলাল ট্রেডিংয়ের মালিক মো. বেলাল উদ্দিনের গুদামে খালাসের সময় পুলিশ তা আটক করে। এ ঘটনায় ট্রাকচালক মো. কামরুল রানাকে আসামি করে মামলা হলেও অদৃশ্য থাকে পাচারকারী চক্র।
এছাড়াও গত ১৭ মে পটিয়ার কচুয়াই ইউনিয়ন পরিষদের সামনে থেকে এক ট্রাক চাল আটক করেছিল পটিয়া থানা পুলিশ। চালগুলো মানিকছড়ি খাদ্য গুদামে পৌঁছানোর কথা ছিল। চালগুলো পাহাড়তলী চাল বাজারের ফারুক ট্রেডিংয়ের মালিক ওমর ফারুকের বলে জানিয়েছিল পুলিশ। ২০১৭ সালে হালিশহর কেন্দ্রীয় খাদ্য গুদাম (সিএসডি গুদাম) থেকে চাল পাচারকালে বিপুল সংখ্যক চাল আটক করেছিল র্যাব। এসময় গুদাম ম্যানেজার প্রণয়ন চাকমা ও সহকারী ম্যানেজার ফখরুল আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। চাল ব্যবসায়ীসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
২০২০ সালের এপ্রিলে পাহাড়তলী বাজার থেকে ২১ বস্তা সরকারি ত্রাণের চাল আটক করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চাল ব্যবসায়ী মেসার্স ফারুক ট্রেডার্স থেকে তা উদ্ধার করা হয়েছিল। ২০২১ সালের ২১ এপ্রিল পাহাড়তলী বাজার থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সরকারি ৭০ হাজার কেজি চাল জব্দ করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। এভাবে সরকারি চাল আটক করা হলেও আড়ালে থেকে যায় বাঘর-বোয়ালরা।
চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুমাইয়া নাজনীন গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘প্রোগ্রামের (চালের কর্মসূচি) চাল গুদাম থেকে গুদামে পৌঁছাবে। কোনো সংস্থার ডিও থাকলে সংশ্লিষ্ট গুদাম থেকে উত্তোলন করতে হবে। মাঝপথ থেকে ট্রাক নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।’
সর্ষের মধ্যে ভূত : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খাদ্যবান্ধর কর্মসূচির চাল গুদাম থেকে গুদামে পৌঁছে দেয় পরিবহন ঠিকাদাররা। সরকার থেকে পরিবহন ভাড়া নেয় ঠিকাদাররা। ট্রাক ভাড়া সাশ্রয়ের জন্য গুটিকয়েক ঠিকাদার গুদাম কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চাল তুলে দেয় কালোবাজারিদের হাতে। চাল চলে যায় কালোবাজারে, ইনভয়েস যায় গুদামে। গুদাম থেকে ইনভয়েস পৌঁছে যায় কালোবাজারিদের হাতে। অর্থাৎ কাগজে-কলমে হিসাব-নিকাশ ঠিক থাকে। খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা, পরিবহন ঠিকাদার ও চোরাকারবারি সি-িকেটের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাল পাচার হয়ে আসছে কালোবাজারে।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এসএম কায়ছার আলী পূর্বকোণকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি গঠন করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চাল নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার : বৈরী আবহাওয়ার কারণে চলতি বছর আউশ ও আমন উৎপাদন কম হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ)। এজন্য সরকারকে ১০ লাখ টন চাল আমদানি করতে হবে বলে জানায় সংস্থাটি। খাদ্য বিভাগের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে পূর্বকোণকে বলেন, সরকারের শেষ সময়ে এসে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি বাড়ানো হবে। বরাদ্দও ঠিক রাখতে হবে। কিন্তু ভারত ও মিয়ানমার চালের রপ্তানি শুল্ক বাড়ানোর কারণে চাল আমদানি নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন। এ অবস্থায় কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য রোধ করতে না পারলে সরকারকে আরও বড় মাশুল গুনতে হবে।
পূর্বকোণ/আরডি