১২ বছরের সংসার জীবনে আছে ১০ এবং ৫ বছরের দুই ছেলে। কিন্তু এক যুগের এই সংসারে ইতি টানছেন ফকির হাটের বাসিন্দা শাহজাহান ও ফৌজদারহাটের সানজিদা খানম দম্পতি। দুই সন্তানের মায়াও যেন আটকাতে পারছে না তাদের সংসার। সেই অভিযোগে শাহজাহান- সানজিদা সোমবার কোতোয়ালিতে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) অফিসে আসেন তাদের সংসার জীবনের ইতি (বিচ্ছেদ) টানার কার্যক্রম চূড়ান্ত করতে। স্ত্রীর অভিযোগ স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির মানুষ তার উপর নির্যাতন চালায়। আবার স্বামীর অভিযোগ, স্ত্রী পরকীয়ায় লিপ্ত। শুধু তারা নয়, একই দিনে পারিবারিক আইনে অভিযোগ করা পোশাককর্মী নাছিমা আক্তারও আসেন ব্লাস্ট অফিসে। দুপুর ১২টার দিকে ওই অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে নাছিমা তার অভিযোগ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, পাঁচ বছর আগে বাঁশখালীর ছেলে রফিককে ভালোবেসে সংসার বাঁধেন নাছিমা। কিন্তু সেই সুখ ছয় মাসও স্থায়ী হয়নি তার। ভালোবাসার সংসারে বাসা বাঁধে সন্দেহ আর অবিশ্বাস। স্ত্রী তার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, অন্য নারীর সাথে স্বামীর প্রেমের সম্পর্ক আছে। এজন্য স্ত্রীর ভরণপোষণ দেয় না। তার উপর চালায় শারীরিক নির্যাতন। স্ত্রী নাছিমার বক্তব্য শুনে ব্লাস্ট কর্মকর্তারা আইনি প্রক্রিয়ার কথা তুলতেই তার স্বামী রফিক তখনই মামলা না করার জন্য অনুরোধ করেন। একইসঙ্গে তাদেরকে পুনরায় সংসার করার সুযোগ দেয়ার জন্য রফিক সালিশী কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন। এরপ্রেক্ষিতে ব্লাস্ট কর্মকর্তারা তাদেরকে সুযোগটি দেন এবং ভরণপোষণের দায়িত্ব হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে স্ত্রীকে কিছু টাকা দিতে পরামর্শ দেন।
এর দুই ঘণ্টা পর সালিশীতে হাজিরা দিতে আসেন আরও দুই দম্পতি। এছাড়া নতুন করে অভিযোগ দায়ের করতে আসেন আরেক নারী।
নগরীর কোতোয়ালি থানাধীন রঙ্গম টাওয়ারে অবস্থিত ব্লাস্ট অফিসের এই চিত্র প্রায় প্রতিদিনের। ব্লাস্ট কর্মকর্তারা বলেন, প্রায়দিনই কোনো না কোনোভাবে নারীরাই নির্যাতনের শিকার হয়ে এখানে আসেন আইনি সহায়তা পেতে। বাংলাদেশে নারী নির্যাতন দীর্ঘদিনের সামাজিক ব্যাধি। করোনা পরবর্তী সময়ে এ ব্যাধিটি আরো প্রকট রূপ ধারণ করেছে।
ব্লাস্ট সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে ৫৩টি নারী নির্যাতনের অভিযোগ পড়েছে। এরমধ্যে যৌতুক, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়েছে ২৮টি এবং পারিবারিক আদালতে ২৫টি অভিযোগ পড়েছে। এরপর করোনার মধ্যে ২০২০ সালে সারাদেশ লকডাউন ছিল বেশিরভাগ সময়। লকডাউনের ফাঁকে যে কয়দিন অফিসিয়াল কর্মকা- চলেছে সেই সময়ে ৩৮টি নারী নির্যাতনের অভিযোগ পড়ে। এরমধ্যে যৌতুক, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা ১৬টি। পারিবারিক আদালতে ২২টি অভিযোগ পড়ে। ২০২১ সালে অভিযোগ পড়েছে ৫৩টি। এরমধ্যে যৌতুক এবং নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়েছে ৩০টি। পারিবারিক আদালতে ২৩টি অভিযোগ পড়ে। ২০২২ সালে নির্যাতনের অভিযোগ পড়েছে ৬৮টি। এরমধ্যে যৌতুক, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামালা হয়েছে ৪৫টি এবং পারিবারিক আদালতে ২৩টি অভিযোগ পড়েছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাস (জানুয়ারি-জুন) ২৭টি নির্যাতনের অভিযোগ পড়েছে। এরমধ্যে যৌতুক, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়েছে ১২টি এবং পারিবারিক আদালতে ১৫টি অভিযোগ পড়েছে। তথ্য অনুযায়ী করোনা পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালে সব চেয়ে বেশি অভিযোগ পড়েছে।
ব্লাস্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, যদিও নির্যাতনে শিকার বেশি নারীরা। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষরাও অভিযোগ এনেছেন। তবে বছরে ৩ শতাংশ পুরুষ স্ত্রী’র বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে আইনি সহায়তা চাইতে আসেন। যদিও সেসব বেশিদূর এগোয় না।
দেশে নারীদের প্রতি সহিংসতা বাড়ার কারণ চিহ্নিত করে ব্লাস্টের এডভোকেট জিন্নাত আমিন বলেন, করোনা পরবর্তী সময়ে নারী এবং পুরুষ উভয়ই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। সংসারে দেখা দেয় অভাব অনটন। পুরুষরা স্ত্রীদের কাছে বাপের বাড়ির সহযোগিতা (যৌতুক) দাবি করেন। পরকীয়ার কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় এবং পারিবারিক কলহের অভিযোগে সংসার ভাঙছে।
পূর্বকোণ/আরডি