চট্টগ্রাম শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৪

সর্বশেষ:

শাশ্বত বঙ্গবন্ধুর জীবনালেখ্য যেন এক ধ্রুপদী মহাকাব্য

এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম

১৫ আগস্ট, ২০২৩ | ১:২৬ অপরাহ্ণ

যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই । যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই! তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা। কে আছে বাঙালি তাঁর সমতুল্য, ইতিহাস একদিন দেবে তাঁর মূল্য। সত্যকে মিথ্যার আড়াল করে, যায় কি রাখা কখনো তা।’

১৯৯০ সালে গীতিকার হাসান মতিউর রহমানের লিখা গানটি সুরকার মলয় কুমার গাঙ্গুলী মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে নিজ বাসায় সুর করার সময় সকলেই অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ধ্রুপদী মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর মহ- াকাব্যিক জীবনী এবং সপরিবারে নিহত হওয়ার বিয়োগাত্মক ঘটনা প্রকৃ তপক্ষে কোন একক কবিতা বা অন্যকোন সাহিত্যিক কাঠামোয় পরিপূর্ণ প্রতিফলন নিতান্তই অসম্ভব। তবে তা সর্বোচ্চ মূর্ত হয়েছে এ গানের মাধ্যমে, যেটা শুনলে যে কারও অন্তরের নির্ঝরের বোবা কান্না উথলে উঠবে বৈকি । মধুমতি আর বাঘিয়ার নদীর তীরে এবং হাওড়-বাঁওড়ের মিলনে গড়ে ওঠা বাংলার অবারিত প্রাকৃতিক পরিবেশে গোপালগঞ্জের নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া শেখ মুজিবই একদিন দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের পথ পেরিয়ে বাঙালিকে ধীরে ধীরে সংগঠিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালির চির আরাধ্য স্বাধীনতা এনে দেন । এ স্বাধীনতা এনে দিতে গিয়ে তিনি জীবন দিয়ে রচনা করেছেন এক ঐতিহ- াসিক চির অবিস্মরণীয় ধ্রুপদি মহাকাব্য, যে কারণে তিনি শুধু বাঙালি নয়, সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে আসীন চির অমর মহান নেতা হিসেবে। শেখ মুজিব থেকে তিনি হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধু, বাঙালি থেকে হয়ে উঠেন বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিত্ব।

 

বাঙালির মুক্তির শপথ এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা যেন জন্মের আগেই বুকে ধারণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু । তাইতো তিনি ছাত্রজীবনে ১৯৩৮ সালে কেবল ১৮ বছর বয়সে প্রথম কারাগারে যান অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে। এর পর পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু ১৮ বার জেলে গেছেন এবং মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন দু’বার। তিনি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ রচনা করেছেন ১৯৬৬-৬৯ সালে কারাগারে থাকাকালে। রাজনৈতিক জীবনে বাঙালির মুক্তির জন্য কারাগারে কাটিয়েছেন ৪ হাজার ৬৮২ দিন । অসম্ভব বিস্ময়কর হলেও বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সত্য হলো প্রত্যেকবার কারাবরণ করেছেন বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য, ব্যক্তিগত কারণে একবারও নয়। নেলসন ম্যান্ডেলা যথার্থই বলেছেন ‘It is said that no one truly knows a nation until one has been inside its jails. ́ শুধু আন্দোলন-সংগ্রাম নয় মূলতঃ নেতৃত্ব দিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন, সংগঠিত করেছেন বাঙালিকে পাকিস্তানি শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের জন্য।

 

১৯৪৮ থেকে ৫২’ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ‘৫০ থেকে ৫৪’ জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, ‘৫৪ থেকে ৫৬’ সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসন, ‘৬৪ তে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতা, ‘৬৬ তে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্থাৎ স্বাধিকার তথা ৬ দফা, ‘৬৯-এর গণআন্দোলন, ‘৭১-এ স্বাধীনতার ডাক দিয়ে মহান মুক্তিসংগ্রাম। এভাবে এক হ্যামিলনের বাঁশী- ওয়ালার মুক্তিকামী সুরে যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত কাটিয়েছে বাঙালি ১৯৪৮-৭১ এই ২৩টি বছর, যার ফল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা।

 

সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নেতাকে তাঁর জাতি ও দেশপ্রেম প্রমাণের জন্য মৃত্যুর মুখোমুখি পড়তেও হয় বৈকি। প্রমাণ করতে হয় এ রকম কঠিন সময়েও তিনি দেশের জাতির । জীবন তাঁর কাছে তুচ্ছ। এমন ঘটনা বঙ্গবন্ধুর জীবনে বার বার আসলেও একদম চরম সংকটে পতিত হয়েছিলেন দু’বার। দু’বারই তিনি মুক্তিনায়ক থেকে হয়ে উঠেছিলেন মহানায়ক।

 

১ম বার বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেবার সমস্ত ষড়যন্ত্র আইয়ুব খান করেছিল। আগরতলা মামলার সরকারি নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলা । স্বৈরশাসক তাকে প্রধান আসামি করে ফাঁসিকাষ্ঠে দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু মাথা নত করেননি। এ দেশের সংগ্রামী ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতির পিতার মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছিল। সেই গণআন্দোলন প্রবল গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত করে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে সমবেত লাখো বাঙালির পক্ষে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা হয়। সমাবেশে মুজিব ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগার দফা দাবির পক্ষে তার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় নির্জন সেলের সামনে কবর খুঁড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভয় পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অসীম সাহসী বাঙালির নেতা শেখ মুজিব ভয় পাননি; বরং পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে বলেছেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মুসলমান, আমি মানুষ । মানুষ একবার মরে, বারবার মরে না। আমি কখনই আত্মসমর্পণ করব না। যদি তোমরা আমাকে মেরে ফেল, মৃত্যুর পর আমার লাশটা আমার দেশে-আমার মানুষদের কাছে পৌছাইয়া দিও।’ বঙ্গবন্ধুর এমন বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য তার আপসহীন মনোভাব, অসীম দেশপ্রেমের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের অকুতোভয় মৃত্যুঞ্জয়ী মহান বীরের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাঙালি জাতির জন্য রেখে গেছেন।

 

পৃথিবীতে অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছে আলোচনার টেবিলে বসে। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছেন রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। নিজ জীবনকে তিনি বাঙালি জাতির জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন বলেছিলেন, “যে মরতে চায়, তাকে কেউ মারতে পারে না।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, তার মৃত্যু নাই।’ বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের একজন মহান নেতা, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ । তিনি চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন। একবার যে সিদ্ধান্ত নিতেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হলেও আপস করতেন না।

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর চির আরাধ্য স্বাধীনতা হাতের মুঠোয় পেয়েও বাঙালি প্রকৃতপক্ষে এর স্বাদ অনুভব করে ৭২-এর ১০ জানুয়ারি, যেদিন মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু তাঁর চির-স্বজন বাঙালিদের বিরহ বুকে নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। সেদিন রেসকোর্স ময়দানের সর্বকালের সর্ববৃহৎ জনসমুদ্রে হৃদয়ের অর্ঘ্য ঢেলে আবেগমথিত ভাষায় বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ বুকে বাঙালি জাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিজ্ঞা নিয়ে জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘ভাইয়েরা, তোমাদেরকে একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। আজকে আমি বলি, আমাদের উন্নয়নের জন্য আমাদের ঘরে ঘরে কাজ করে যেতে হবে।’

 

অসাম্প্রদায়িক ও আদর্শিক রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্ন দু’চোখে বুনে বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে-গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।’

 

আবেগাপ্লুত কণ্ঠে কবিগুরুর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কবিগুরুর আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। বাঙালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে। এমন কাজ তারা এবার করেছে, যার নজির ইতিহাসে নাই। ‘হে কবিগুরু আপনি এসে দেখে যান, আমার ৭ কোটি বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র ৭ মাসের মধ্যে জাতিকে উপহার দেন স্বাধীন দেশের উপযোগী বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান । অকুতোভয় সংগ্রাম, অসীম দেশ প্রেম, মহীরূহ ব্যক্তিত্ব ও ধ্রুপদি জীবন কাব্যের জন্য ছোট দেশের বড় নেতা বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় নেতা থেকে বিশ্ব নেতা। আলজেরিয়াতে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ সেই বক্তৃতা সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। জাতিসংঘে প্রিয় মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। বক্তৃতায় বলেছেন, ‘মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার।’ যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে যান তখন দেশটির শীর্ষ চার নেতা পোদগর্নি, কোসিগিন, ব্রেজনেভ ও আঁন্দ্রে গ্রোমিকো তাকে অভ্যর্থনার জন্য ক্রেমলিনে সমবেত হন। ব্রেজনেভ বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমি ধন্য। আজ আপনার মতো মহান নেতার সান্নিধ্য লাভ করেছি।’ জাপান সফরকালে সম্রাট হিরোহিতো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে করমর্দন করে বলেছিলেন, ‘সত্যিই আপনি ইতিহাসের একজন মহান নেতা।’ ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আই ফিল ফর মাই কান্ট্রি অ্যান্ড মাই পিপল, অ্যান্ড দ্যান মাই ফ্যামিলি।’ সবকিছুর উর্ধ্বে জাতির পিতার কাছে ছিল বাঙালি ও বাংলাদেশ । দীর্ঘ কারাবাসের পর পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে পৌঁছার সংবাদ শুনে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তৎক্ষণাৎ অবকাশ কেন্দ্র থেকে ফিরে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়ে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আপনি একজন মহান নেতা এবং আমি কখনোই ভাবিনি আপনার সঙ্গে দেখা হবে।’ কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও কিংবদন্তি বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো।’

ফিলিন্তিন মুক্তি মোর্চার সাবেক নেতা, নোবেল বিজয়ী ইয়াসির আরাফাত বলেছেন, ‘আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব ও কুসুমকোমল হৃদয় ছিল মুজিবের চরিত্রের বিশেষত্ব। তিনি বাংলাদেশের জনগণকে নিজ সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের ‘আপনার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা কী’ এ প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি।” ডেভিড ফ্রস্টের ‘আপনার বড় দুর্বলতাটা কী’- এ প্রশ্নের উত্তুরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশের মানুষকে বেশি ভালোবাসি।’ এ কথার মাধ্যমে জনগণের প্রতি জাতির পিতার অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের প্রতি বিশ্বাসের বিষয়টিও সুস্পষ্ট। কিন্তু বিশ্বাস করতে মন চায় না এমন বিশ্বনেতাকে স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালরাতে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল এই দেশেই। যে পাকিস্তানিরাও সাহস করেনি তাকে হত্যা করতে স্বাধীন দেশে সেই বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করা হয়েছিল। সেদিন শ্রাবণের রাতে কালো মেঘের অশ্রু হয়ে ঝরেছিল যেন বাঙালির হৃদয়ের বাতিঘর বঙ্গবন্ধুর রক্ত। তাই তো বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সব সদস্যরা এমনকি নারী বা শিশু রাসেলও বাদ যায়নি। দু’কন্যা বেঁচে গিয়েছিলেন সৌভাগ্যক্রমে দেশের বাইরে থাকার কারণে। ১৫ আগস্টের সেই কালরাতে ঘাতকের হাতে নিহত হন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল ও সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক। প্রায় একই সময়য়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত ও এক আত্মীয় আবদুর নঈম খান রিন্টুকে হত্যা করে।

 

বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্ককে দীর্ঘতর করার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের ঘৃন্য স্বৈরশাসকগণ বঙ্গবন্ধুর ১২ খুনিকে কয়েকটি দেশের দূতাবাসে চাকরি দেন। খুনিদের যেন বিচার না হয় সেজন্য ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেম – নিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত যারাই ক্ষমতায় ছিল সবাই এই কালআদেশ বহাল রেখেছে। বহাল রেখেছে খুনিদের চাকরিও। আর এই সময়ে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নামে নানা মিথ্যা ছড়ানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে টানা ২১ বছর তো বঙ্গবন্ধুর নামটাও নেওয়া যেত না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর এই মামলার রায়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২৮ জানুয়ারি পাঁচ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়। ছয় খুনি বিদেশে পলাতক। তবে খুনিদের ফাঁসি দেয়াই যথেষ্ঠ নয়। এর মদদ দাতা ও নাটের গুরুদের অবশ্যই তদন্তপূর্বক চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তাঁর অনন্য সাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেন, সহিংস ও কাপুরুষোচিতভাবে বাংলাদেশের জনগণের মাঝ থেকে এমন প্রতিভাবান ও সাহসী নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়া কী যে মর্মান্তিক ঘটনা! তারপরও বাংলাদেশ এখন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে, তাঁরই কন্যার নেতৃত্বে। যুক্তরাষ্ট্র তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণে বন্ধু ও সমর্থক হতে পেরে গর্ববোধ করে।

ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাসা পরিদর্শনে এসে হলিউড অভিনেত্রী, চলচ্চিত্রকার এবং মানবাধিকার কর্মী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি বলেন, এই বিশেষ বাড়িটিতে এসে আমি বেশ আবেগাপ্লুত! বাড়িটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে জেনে আমি কৃতজ্ঞ।

বঙ্গবন্ধু আমাদের অসীম সাহসিকতার প্রতীক। তিনি সমগ্র বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর । ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, তিতুমীর, সুভাষ বোস, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জগদীশ চন্দ্র বসু, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর মতো সাহসী নেতৃত্বের নির্যাস তিনি নিজের মধ্যে ধারণ করতেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন গরিব- দুঃখীসহ সমগ্র বাঙালির সত্যিকারের মহান বীরপুরুষ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে যারা তাঁর আদর্শকে হত্যা করতে চেয়েছিল সে নরপিশাচরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বঙ্গবন্ধু প্রাণস্পন্দন হয়ে বেঁচে আছেন কোটি বাঙালির হৃদয়ে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চির প্রবাহমান থাকবে প্রজন্মান্তরে । বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যথার্থই বলেছিলেন ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান। /দিকে দিকে আজ অশ্রুমালা রক্তগঙ্গা বহমান/তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।

লেখক : চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট ।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট