চট্টগ্রাম বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রামে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা

‘পাহাড়ে অবৈধ সংযোগ দিলে বিভাগীয় ও ফৌজদারি মামলার হুঁশিয়ারি’

নিজস্ব প্রতিবেদক

৮ আগস্ট, ২০২৩ | ৯:১৯ অপরাহ্ণ

পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগদানে সহায়তাকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি মামলা করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার। একই সঙ্গে অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করে স্থায়ীভাবে সরকারি সম্পত্তি রক্ষার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। এজন্য সিটি করপোরেশন, রেলওয়ে ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মধ্যে আন্তঃদপ্তর আলোচনা করে উচ্ছেদ-পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের নির্দেশনা দেন তিনি।

 

আজ মঙ্গলবার (৮আগস্ট) দুপুর সোয়া ১২টায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৭তম সভায় এসব নির্দেশনা দেন পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম।

 

তিনি বলেন, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে হবে। আর ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়ের বিষয়ে বলার কিছুই নেই। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে পাহাড় মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মালিকানাধীন পাহাড় অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করার পর যাতে বেদখল না হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

 

বিভাগীয় কমিশনার আরও বলেন, পাহাড়ে বসবাসকারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ভাড়াটিয়া। অবৈধ দখলদারদের তালিকা করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। মূল মালিক কাকে ভাড়া দিয়েছে, ভাড়ার শর্ত মানা হচ্ছে কি না-তা মনিটরিং করতে হবে।

 

তিনি বলেন, পাহাড় কাটার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও পুলিশ মামলা এবং জেল-জরিমানা করতে পারে।

 

সভার সভাপতি ও বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন ও অবৈধ বসতি উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ফয়’স লেক উচ্ছেদ অভিযানে সিটি করপোরেশন, রেল ও পরিবেশ অধিদপ্তর যৌথভাবে করণীয় নির্ধারণ করবে। পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে।

 

একজন কাউন্সিলরের পাহাড় দখল, পাহাড় কাটার বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, সরকারের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নেই। সরকারের সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে এ কমিটি। তাই কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

 

কমিটির সভায় সভাপতি তোফায়েল ইসলাম বলেন, ‘অবৈধ দখলদার তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগে সহায়তারকারী বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে হবে।’

 

সভার সভাপতি ও বিভাগীয় কমিশনার বলেন, উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন ও অবৈধ বসতি উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ফয়’স লেক উচ্ছেদ অভিযানে সিটি করপোরেশন, রেল ও পরিবেশ অধিদপ্তর যৌথভাবে করণীয় নির্ধারণ করবে। পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে।

 

তিনি বলেন, ‘পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বৈধ সংযোগ নিতে বেগ পেতে হয়। এখানে অবৈধ সংযোগ পায় কীভাবে। আগামীতে কোনো প্রকল্প নেওয়ার আগে ভূমি মালিকের অনুমোদন বা সম্পৃক্ত করার অনুরোধ করেছেন তিনি।

 

সভায় পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূরেআলম মিনা বলেন, জেলা ও উপজেলায় পাহাড় রয়েছে। এখন থেকে তা রক্ষা করা না হলে ভবিষ্যতে উচ্ছেদ কঠিন হয়ে পড়বে। অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ সিএমপি ও জেলায় সহায়তা করার জন্য পুলিশ করে যাচ্ছে। দখলদার চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, জেলা প্রশাসন নিয়মিতভাবে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে আসছে। ফয়’স লেকের বেলতলী ঘোনায় ১০ একর জায়গা থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হয়েছে। পরবর্তীতে যাতে বেদখল না হয়, সেজন্য নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে প্রবল বৃষ্টির কারণে যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু না ঘটে সেজন্যে বিজয় নগর ও ঝিল পাহাড় থেকে প্রায় ১১০০ পরিবারকে নামিয়ে আনা হয়েছে। তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে নিয়মিত তিনবেলা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।

 

জেলা পুলিশ সুপার এসএম শফি উল্লাহ বলেন, পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ কীভাবে দেওয়া হয়েছে তার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের শোকজ করা দরকার। জমির বৈধ কাগজপত্র ছাড়া কীভাবে সংযোগ দেওয়া হয়। সবার দায়িত্ব আছে, কিন্তু দায় এড়াতে পারে না।

 

এসপি বাংলোর নিচে ২৫০ অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘৭০ বছর ধরে অবৈধ বসতি চলে আসছে। আমরা উচ্ছেদ করে দিয়েছি। সরকারি পাহাড়ে ৮০ শতাংশ ভাড়াটিয়া। ২০ শতাংশ অবৈধ দখলদার। ভাড়া দিয়ে লাখ লাখ টাকা আয় করছে। এখানে মাদক ব্যবসা, জুয়া, অবৈধ কার্যকলাপ, মারামারি ও সহিংসতা ঘটনা ঘটে। জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন ভাড়া দেন। ইচ্ছে করলেই দখলদার উচ্ছেদ করতে পারবো। সরকারি জমি উদ্ধার করতে পারবো।

 

রেলওয়ের মালিকানাধীন পাহাড়ে রাস্তা নির্মাণের বিষয়ে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, মতিঝর্না এলাকায় ৪-৫ তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ দখলে রয়েছে। উচ্ছেদ করতে গেলে ৫০০-১০০০ লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায়। তা উচ্ছেদ করা কঠিন। স্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সমন্বিতভাবে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। পরবর্তীতে যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য স্থায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নতুন করে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ না দেওয়ার জন্য কঠোর নির্দেশনা দেন বিভাগীয় কমিশনার। নতুন সংযোগের বিষয়ে মালিকানা যাচাই-বাছাই করার অনুরোধ জানান সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব মাসুদ কামাল বলেন, রেলওয়ের সাতটি পাহাড়ে ৫ হাজার ৩৩২টি অবৈধ পরিবারের বসতি রয়েছে। জেলা প্রশাসন নিয়মিত পাহাড় থেকে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আশ্রয়ণকেন্দ্র খোলা ও খাবারের ব্যবস্থা করছে। আকবর শাহ থানার তেলতলী এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে ৫শ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। গত আগস্ট মাসে আকবরশাহ এলাকার বিজয়নগর, ঝিল পাহাড়, শান্তিনগর, বেলতলীঘোনা ও মতিঝর্নায় অভিযান চালিয়ে ১১শ পরিবারকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 

সভায় রেলওয়ের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বলেন, রেলওয়ের বিভিন্ন পাহাড়ে অবৈধ বসতি রয়েছে। ফয়েস লেক ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিলে ৪ হাজার ৪৭৬ জন অবৈধ বসতি রয়েছে। ৩-৪টি মামলা চলমান রয়েছে। ইচ্ছে থাকলেও অভিযান পরিচালনা করা দুরূহ বিষয়। রেলওয়ের বিভিন্ন পাহাড়ে বিদেশি অর্থায়নে ড্রেন ও রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। রেলওয়ে থেকে কোনো ধরনের অনুমতি নেওয়া হয়নি। এসব সুবিধার কারণে পাহাড় বেদখল, ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উৎসাহিত হবে। ফয়েস লেক ছাড়াও মতিঝর্না ও বাটালি হিলে পাহাড় রাস্তা নির্মাণ, পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ রয়েছে।

 

বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সিডিএ, ওয়াসা, বিদ্যুৎ ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা- প্রতিনিধিরা সভায় উপস্থিত ছিলেন।

 

পূর্বকোণ/জেইউ/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট