চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

ট্রাম্পের চার্জশিট, অভিযোগের তাৎপর্য

ওয়াহিদ জামান

৫ আগস্ট, ২০২৩ | ৭:২৬ পূর্বাহ্ণ

বৃহস্পতিবার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাদবাকি বিশ্ব আরও একবার, দেশটির সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল। মিডিয়াতে, এটি বিস্তৃতভাবে বলা হয়েছে যে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলকে উল্টে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাচকদের ভোট গণনাকে প্রভাবিত করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনটা বৈধ, কিংবা কোনটা আইনসিদ্ধ নয় তা সবসময় বোঝা সম্ভব হয় না। তাই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে কী অভিযোগ আনা হচ্ছে এবং আইনের আদালতে কিংবা জনগণের আদালতে এই অভিযোগগুলির তাৎপর্যটা কী একটু যাচাই করে দেখা যাক।

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটন ডিসির আদালতে চারটি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল। এগুলো হলো: যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতারণা করার ষড়যন্ত্র। একটি দাপ্তরিক কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার ষড়যন্ত্র। অফিসিয়াল কার্যক্রমে বাধা এবং বাধা দেওয়ার চেষ্টা। জনগণের ভোট গণনার অধিকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা।
মার্কিন সংবিধান বলে যে, ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটগুলি একটি রাজ্য স্তরে গণনা করা দরকার এবং তারপরে আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন কংগ্রেস দ্বারা সমর্থিত এবং অনুমোদিত হয়। আমাদের মনে রাখা উচিত যে, সাংবিধানিক পরিভাষায় জনপ্রিয় ভোট হল ইলেক্টোরাল কলেজ নির্ধারণের একটি মাধ্যম, এবং জনপ্রিয় ভোটের ভিত্তিতে তাদের রাজ্যের ইলেক্টোরাল কলেজে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচকদের নিয়োগ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাজ্যগুলির যথেষ্ট এখতিয়ার রয়েছে।

৬ জানুয়ারি ২০২০ ছিল সেই আনুষ্ঠানিক তারিখ যখন রাজ্যের নির্বাচকদের গণনা কংগ্রেস অনুমোদন করবে এবং এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবে।
অভিযোগে মূলত বলা হয়েছে, যে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প সক্রিয়ভাবে এবং জেনেশুনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে বাতিল করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন যে নির্বাচনের ফলাফলে জালিয়াতি ছিল এবং তিনি আসলেই নির্বাচনে জিতেছিলেন, যদিও তার নিজের কর্মী এবং সরকারি কর্মকর্তারা বারবার বলেছিল যে কোনও প্রমাণ নেই।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, মার্কিন আইন এবং মার্কিন সংবিধানের অধীনে একটি নির্বাচনকে জালিয়াতিপূর্ণ দাবি করা বা এমনকি এই সম্পর্কে মিথ্যা বলা বেআইনি কিছু নয়। আইন যা বলে তা হল, কোন ব্যক্তি যদি জানে যে দাবিগুলি ষড়যন্ত্রমূলক করা (ইচ্ছাকৃতভাবে), নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য-তবে অবশ্যি এটা বেআইনি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-কারণ এটি বাকস্বাধীনতার কোনোও সমস্যা নয়। যদিও অনেকেই তেমনটিই (বাকস্বাধীনতার সমস্যা) মনে করে থাকে। মিথ্যা বলাটাও কোনো বিষয় নয়। অপরাধের মূল বিষয়টি লুকিয়ে আছে- ‘জেনেশুনে একটি নির্বাচনকে উল্টে ফেলা বা বিকৃত করার অভিপ্রায়ের সাথে ।’
বৃহস্পতিবার যা ঘটেছিল তার বিশাল তাৎপর্য রয়েছে।
বর্তমানে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প তিনটি পৃথক মামলার জন্য ফৌজদারি অভিযোগের অধীনে রয়েছেন : ট্যাক্স এবং আর্থিক প্রতিবেদন জালিয়াতির জন্য নিউইয়র্কের মামলা, অবৈধভাবে শ্রেণীবদ্ধ নথি রাখার বিষয়ে মার-এ-লাগো মামলা এবং এখন সম্ভাব্যভাবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর (ঐতিহাসিক দিক থেকে)- অফিসে থাকাকালীন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে উল্টে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের। যে অপরাধের বিচার করা হচ্ছে তা হল, মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি ভিত্তিপ্রস্তর, ‘শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর’-জেনেশুনেই নস্যাৎ করার চেষ্টা করার। এক্ষেত্রে আমাদের অভিযুক্তকে জনমতের আদালতের লেন্স দিয়ে দেখতে হবে, শুধু আইনের দৃষ্টিতে নয়।

এটা অনেকটাই বিরক্তিকর যে, ট্রাম্পের প্রতিটি অভিযোগের সাথে সাথে, রিপাবলিকান ভোটারদের মাঝে তার সমর্থনের মাত্রা সত্যিই বেড়ে গেছে। ট্রাম্প ২০২৪ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রিপাবলিকান মনোনয়নের দৌড়ে সামনের দিকেই রয়েছেন। যদি এমনটিই হয়, তবে আমরা ২০২৪ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের শীর্ষস্থানীয় এমন এক প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখবো যিনি একাধিক অপরাধের জন্য ফৌজদারি অভিযোগের অধীনে রয়েছেন।
যদি সত্যিই তিনি বর্তমান মামলার অধীনে কোনো অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে আমাদের সামনে আরও বেশি বিরক্তিকর দৃশ্য অপেক্ষা করছে- আসছে নির্বাচনে এমন একজন প্রার্থী নির্বাচন করছেন যিনি একজন দ-িত অপরাধী। স্পষ্টতই এখানে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প নির্বাচনের পর পর্যন্ত বিচার বিলম্বিত করার চেষ্টা করছেন, যাতে রাষ্ট্রপতি হিসাবে তিনি হয় নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন বা ফেডারেল মামলাগুলির বিচারে হস্তক্ষেপ করতে পারেন বা সাজা কার্যকর করতে অস্বীকার করতে পারেন। মনে হয় আমরা একটি সম্পূর্ণ অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক দৃশ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
উপরন্তু, এখন বাস্তবতা হল যে, মার্কিন সমাজ গভীরভাবে মেরুকৃত। গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ১৬০ মিলিয়ন ভোটের মধ্যে ১ লাখ ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এখন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সমস্ত সাফল্য সত্ত্বেও, সমর্থকদের মধ্যে তার বয়স সম্পর্কে একট উদ্বেগ রয়ে গেছে। পরবর্তী মেয়াদ শুরু হলে ৮২ বছর বয়সে তিনি হবেন ইতিহাসের সবচেয়ে বয়স্ক রাষ্ট্রপতি। সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা গেছে-এখন রাষ্ট্রপতি বাইডেন এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের মধ্যে সমর্থনের ব্যবধান রয়েছে মার্জিনাল। নির্বাচন পর্যন্ত এ ধারা বজায় থাকলে ট্রাম্পের নির্বাচিত হয়ে আসার বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে-সমস্ত সমস্যা তাকে ঘিরে থাকা সত্ত্বেও তিনি আবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে পারেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মূল লেখকরা এমন একটি সরকার ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন যা স্বীকার করেছিল যে, শাসনব্যবস্থায় দল-উপদল বিদ্যমান থাকবে এবং শক্তিশালী জননেতাদের উচ্চাকাক্সক্ষা এবং নানা অভিপ্রায়কে সামাল দেবার জন্য একটা ‘চেক এন্ড ব্যালান্স’ ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে।
অফিসে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ এই শাসনব্যবস্থাকে দারুণ পরীক্ষার মুখে ফেলবে কারণ ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনের অধীনে বর্তমান যে কোনও বিচারাধীন মামলা যে কোনওভাবেই হোক বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং, ২০২৪ সালের নির্বাচন থেকে পরবর্তী ১৮ মাস এই সাংবিধানিক কাঠামোকে চূড়ান্ত পরীক্ষায় ফেলবে।
গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারের জন্য জনগণ কি তাদের সঠিক প্রতিক্রিয়াটি জানাবে কিংবা যথাযথ হস্তক্ষেপটি করবে? শেষ পর্যন্ত এটি যেমন জনগণের ইচ্ছার পরীক্ষা, তেমনি এটি আইনের শাসনের পরীক্ষাও।
লেখক : সিইও, ডব্লিউএন্ডএ কনসাল্টিং : প্রাক্তন প্রধান কৌশলী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা হারশে (Hershey), ফার্মার ব্রাদার্স’র পরিচালনা পরিষদের সদস্য। এছাড়াও ‘ফরচুন ফাইভ হানড্রেড’ কোম্পানির বেশ ক’টি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে উদ্যোক্তাদের পরামর্শ আর সিনিয়র এক্সিকিউটিভদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

শেয়ার করুন