প্রক্রিয়াজাত কাঁচা চামড়া বেচাকেনা শুরু করেছেন চট্টগ্রামের আড়তদার ও বেপারিরা। তবে সরকারি দরে চামড়া বিক্রি ও বিক্রির টাকার নিশ্চয়তার বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন আড়তদাররা। কারণ ‘বিশ্বাসের’ উপর ভিত্তি করে চামড়া বেচাকেনা হয়। এ সুযোগে কোটি কোটি টাকা অনাদায়ী রয়ে গেছে আড়তদারদের। এতে পুঁজি হারিয়ে অনেক বেপারি এখন নিঃস্ব ও দেউলিয়া হয়ে গেছেন।
আড়তদার হাজি মোহাম্মদ আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মুখে মুখে বিশ্বাসের ভিত্তিতে কাঁচা চামড়া বেচাকেনা হয়ে আসছে। একেবারে আল্লাহর ওয়াস্তে। বাকিতে বিক্রি করে টাকা না পেয়ে অনেক ব্যবসায়ী এখন নিঃস্ব হয়ে গেছেন।’ তিনি বলেন, ‘বিক্রি করার টাকা অনাদায়ী থাকায় পুঁজি হারিয়ে ফেলেছেন। অনেকেই ঋণ ও ধার-দেনার বোঝা মাথায় নিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছে। এসব কারণে চামড়া ব্যবসায়ী কমে গেছে।’
আড়তদার মো. আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোরবানের দুই দিন আগে তৎপর হয়। দেশের সম্পদ চামড়া রক্ষার অনুরোধ করে। এরপর আর কোনো খবর রাখে না। চামড়া বিক্রিতে কোটি কোটি টাকা বকেয়া থাকলেও সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।’
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, ‘চামড়া পাঠানোর বিলের উপর ক্রেতা-বিক্রেতার স্বাক্ষরে চামড়া বেচাকেনা হয়। বাকিতে বিক্রয়ের বিপরীতে ব্যাংক চেক বা আইনি ভিত্তিমূলক কোনো কাগজপত্র দেওয়া হয় না। এতে আড়তদার বা ব্যবসায়ীরা পাওনা আদায়ের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে না। এরফলে চট্টগ্রামের আড়তদারদের ২০-২২ কোটি টাকা এখনো অনাদায়ী রয়ে গেছে ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে। বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে চামড়া বিক্রি করে বাকি টাকা আদায় করতে না পেরে ব্যবসায় টিকে থাকতে পারেনি অনেক ব্যবসায়ী।
বকেয়া টাকা আদায় ও চামড়া বেচাকেনায় আইনি ভিত্তিমূলক উদ্যোগ গ্রহণের দীর্ঘদিন ধরে সরকার ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দাবি করে আসছি। তারপরও সরকার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। বললেন আড়তদার সমিতির সভাপতি মুসলিম উদ্দিন।
চট্টগ্রামে আড়তদার সমিতির সদস্য রয়েছেন ১১২ জন। সমিতির সদস্যসহ অন্তত ২৫০-৩০০ জন আড়তদার ও ব্যবসায়ী চামড়া বেচাকেনায় জড়িত ছিলেন। বর্তমানে চামড়া কেনাবেচায় আছেন সমিতির ২০-২৫ জন আড়তদার। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চামড়া বেচাকেনা করে ট্যানারি মালিকদের কাছে ২০-২৫ কোটি টাকা আটকে যায়। বছরের পর বছর পুঁজি আটকে থাকায় অনেকেই পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। ব্যবসা করার মতো পুঁজি খাটাতে পারছেন না।
গত কোরবানি ঈদের এক কোটি ২০ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে দাবি করে আড়তদার মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘পুরোনো বকেয়া রয়েছে ৭-৮ কোটি টাকা। গত বছরের টাকাও পাইনি। প্রায় ৮-৯ কোটি টাকা বকেয়া আটকে রয়েছে। পুঁজি ছাড়াও ঋণ ও ধার-দেনার টাকা পরিশোধ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দুশ্চিতায় রয়েছি।’
চট্টগ্রামের আড়তদাররা লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত চামড়া বিক্রি শুরু করেছেন। ইতিমধ্যেই ঢাকার ট্যানারি, আড়তদার ও উত্তরবঙ্গের আড়তদারদের কাছে ৩০-৪০ হাজার পিস চামড়া বিক্রি করেছেন। ঢাকার ট্যানারি মালিকেরা এখনো পুরোদমে বেচাকেনা শুরু করেনি। তবে সরকারি দরে চামড়া বেচাকেনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আড়তদাররা।
আড়তদার মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সরকার বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে প্রতি ফুটে ৫ টাকা কমে বিক্রি করবো। তারপরও তো ট্যানারি মালিকেরা সেই দর দেয় না। কিন্তু কোরবানের আগে সরকার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যানারি মালিকেরা কেন দর বেঁধে দেয় তা বোধগম্য নয়।’
তবে আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এখনো পুরোদমে বেচাকেনা শুরু হয়নি। নগরী ও জেলায় মিলে ৩০-৪০ হাজার পিস চামড়া বিক্রি হয়েছে। মনে হচ্ছে, সরকারি দরে বেচাকেনা হচ্ছে। না হলে আড়তদার ও বেপারিরা অভিযোগ করতো।’
একই কথা বললেন সভাপতি মুসলিম উদ্দিনও। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে কিনে নিয়ে ঢাকার আড়তদাররাও আবার লাভ করবেন। লাভ না হলে তো বেচাকেনা শুরু হতো না।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, চট্টগ্রামে এবার তিন ১৮ হাজার ৮শ পিস চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। এরমধ্যে গরু ও মহিষের চামড়া রয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার। ছাগলের চামড়া ৫৩ হাজার ৮শ পিস। গত বছর (২০২২ সাল) তিন লাখ ৪৩ হাজার ২৫০ পিস চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছিল।
প্রতি বছর কোরবানির আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যানারি ও আড়তদারদের সঙ্গে বৈঠক করে চামড়ার দর বেঁধে দেয়। এবার ঢাকার বাইরের চামড়ার দর দিয়েছে প্রতি বর্গফুটে ৪৫-৪৮ টাকা। সেই হিসাবে চট্টগ্রামে সংগ্রহ করা চামড়া ২৪-২৫ কোটি টাকা বেচাকেনার আশা করছেন আড়তদাররা।
পূর্বকোণ/মাহমুদ