পৃথিবীতে এখন বড় রাজনীতি হলো, মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখতে পারার কৌশল বাস্তবায়ন করা। সম্ভবত বাজার অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সাফল্যও এটি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষার প্রসারের নামে মানুষকে অশিক্ষিত ও কুশিক্ষিত বানিয়ে রাখাও রাজনৈতিক দর্শনের অংশ হয়ে উঠেছে। সে বিবেচনায় আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন– কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রভাব বিস্তার করে যদি মানুষকে বিচার-বিবেচনাহীন করে রাখা যায়, মানুষের কাছে মানুষ যদি প্রয়োজনহীন হয়ে পড়ে, তবে সেই মনুষ্যহীন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কী?
ছোটবেলায় আমরা গণিত অনুশীলন করতাম। রাফ খাতার সেই গণিত হয়তো পরীক্ষার বৈতরণী পার হওয়া ছাড়া তেমন কাজে না লাগলেও দীর্ঘ অনুশীলনের ফলে আমাদের মগজ সুঠাম হয়েছে। একইভাবে পৃথিবীতে অনেক কাজই হয়তো সরাসরি আমাদের ফল দেয় না। ফল পেতে সহায়তা করে। এ জন্য কাজ করা জরুরি। বিশেষত মগজের কাজ। হাল আমলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নাম করে একদল মানুষ মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে সবকিছু খেলোভাবে উপস্থাপন করার কৌশল হাতে নিয়েছে, যা প্রকারান্তরে মানুষের জীবনকে কঠিন করে তুলবে। স্মর্তব্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ শক্তিকে মানুষের সহায়ক শক্তি ব্যবহার করে কাজের গতি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে এসব প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতামূলক আত্মসমর্পণ হবে আত্মঘাতী।
একটি গাড়িকে দীর্ঘদিন ব্যবহার না করে বসিয়ে রাখলে কিছুদিন পর তা অকেজো হয়ে যায়। সচল রাখতে হলে গাড়িটিকে নিয়মিত স্টার্ট দিতে হয় এবং সড়কে নামাতে হয়। শুধু গাড়ি নয়; ইলেকট্রনিক যে কোনো যন্ত্রের ক্ষেত্রে এ কথা যেমন প্রযোজ্য, তেমনি মানুষের ক্ষেত্রেও তা সত্য। কাজ ও অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে মানুষও অকর্মণ্য হয়ে যেতে পারে। পরিশ্রমবিমুখ হয়েও মানুষের শেষরক্ষা হয় না। অতিরিক্ত আরাম-আয়েশে থাকা মানুষকে শেষ পর্যন্ত ব্যায়ামাগারে গিয়ে ঘাম ঝরাতে হয়।
পৃথিবীর আদি থেকে পরিশ্রম মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। পৃথিবীর সবকিছু বদলে ফেলতে হবে এমন তো কথা নেই। সর্বকালে সর্বত্র পরিশ্রমের গুরুত্ব স্বীকার করা হয়েছে। বর্তমানে যদি আমরা পরিশ্রমহীন পৃথিবী গড়ার কথা বলি, পরিশ্রমহীন প্রকল্পকে অধিকতর গুরুত্ব দিই এবং সেখানে পরিশ্রমহীন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করি, তবে তা হবে বালখিল্যতা। আমরা হয়তো ভাবতে পারি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের পরিশ্রমহীন শান্তি এনে দেবে এবং অতঃপর আমরা সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকব। প্রকৃত অর্থে তা বোকার স্বর্গে বসবাসেরই নামান্তর। এতদিন দরিদ্র যে মানুষটি পরিশ্রম করে টিকে থাকতে চাইতেন, তিনিও তখন পরিশ্রমকে ঘৃণা করতে শিখবেন। ভাববেন, পরিশ্রম নিচু শ্রেণি বা অশিক্ষিত মানুষের কাজ।
পৃথিবীতে বহু প্রাচীন বস্তু ও বিষয় বিদ্যমান। যেমন– সূর্য। পৃথিবীর আদি থেকে সূর্য একইভাবে আলো ছড়িয়ে চলেছে। মাঝে কিছু বিষয় পরিবর্তন করে হয়তো ভাবছি– আমরা পৃথিবীর অনেক পরিবর্তনের অনুঘটক। যেমন– আবাসন খাতের ব্যবসার কথা চিন্তা করা যায়। এ ব্যবসায় দুটি শব্দকে কৌশলে আয়ত্তকরণপূর্বক প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে– ডেভেলপমেন্ট ও ডেভেলপার। ফলে এমনকি গ্রামের মধ্যেও কোনো বড় ভবন বা কাচঘেরা বাড়ি দেখলে আমরা ভাবি উন্নয়ন হয়েছে। এলাকাটির ‘ডেভেলপমেন্ট’ হয়েছে। পক্ষান্তরে কোথাও কৃষ্ণ সবুজ দেখলে ভাবি– আহ, আজও এই এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগল না। তখন এমনকি না বুঝে দুঃখও করি।
অবনতিকে আমরা উন্নতি হিসেবে দেখতে শিখছি। প্রকৃত উন্নতির কথাও আমরা ভাবছি না। উঁচু উঁচু ভবন এবং ইট-পাথরের অবকাঠামো নির্মাণই এখন আমাদের কাছে উন্নয়ন হয়ে উঠেছে। মানবিক উন্নয়ন থেকে যাচ্ছে চিন্তার বাইরে। আলোর নামে অন্ধকার আর শিক্ষার নামে অশিক্ষা বিলি করে এবং উন্নয়নের নামে ঊন্য়ননে দেখছি না তো সবকিছু? তথ্যসূত্র: সমকাল
লেখক: ড. সৈয়দ মিজানুর রহমান, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের ডিরেক্টর।
পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ