চারপাশে নীল জলরাশি। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে উঁচু দেয়ালে। খালি চোখে দেখলেই বোঝা যায় কতটা শক্তিশালী সে দেয়াল। প্রাচীনকালে শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে এ ধরনের পুরু দেয়াল দিয়ে দুর্গ নির্মাণ করা হতো। দেয়ালের ভেতর দিকে প্রথমে ছোট ছোট ঘর। এরপর মাঝখানে সুউচ্চ মঠ। হাজার বছর আগে নির্মিত মন্ট সেন্ট-মিশেল নামের আশ্রমটি সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে। এটি ফ্রান্সের স্থায়ীত্বেরও প্রতীক।
নরম্যান্ডি উপকূলের ছোট্ট এ দ্বীপের মূল আকর্ষণ পাহাড়ের ওপরের আশ্রমটি। নামে মঠ হলেও চেহারা আর নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিক থেকে এটি দুর্গের মতো। এটি শত শত বছর ধরে ফরাসি ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। পাহাড়ের ওপরের দিকের দালানগুলোর বেশিরভাগই ১৩ শতকে গথিক নির্মাণশৈলীতে বানানো। নিচের দিকে ছোট ছোট বাড়িঘর আর দোকানপাট। আশ্রমের সন্ন্যাসীসহ সব মিলিয়ে সেখানে ৫০ জনেরও কম মানুষের বাস।
অতীতে দেশটির সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দ্বীপটি মূল ভূখণ্ডের অংশ ছিল। কয়েকশ বছর আগে সমুদ্রের জোয়ারের ধাক্কায় চারপাশ বিলীন হয়ে ভূখণ্ড থেকে আলাদা হয়ে আটলান্টিকের বুকে আবির্ভাব ঘটে ক্ষুদ্র এই দ্বীপের। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে দ্বীপটির প্রথম যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয় উনিশ শতকের শেষ দিকে। ১৮৭৯ সালে দ্বীপটির সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনে কাঠের একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। যদিও জোয়ারের সময় সেই সেতু ডুবে যেত। ২০১৪ সালে সেখানে একটি স্থায়ী সেতু নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকে জোয়ারের সময়ও খুব সহজেই দ্বীপটিতে আসা-যাওয়া করা যায়।
তবে অতি প্রবল জোয়ারের (সুপারটাইড) সময় নতুন সেতুটিও পানির নিচে তলিয়ে যায়। প্রতি ১৮ বছর পর পর দেখা মেলে সুপারটাইড নামে ভয়ংকর এই জোয়ারের। সর্বশেষ ২০১৫ সালে দেখা গিয়েছিল এই জোয়ার। মূলত সূর্যগ্রহণের কারণে চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যকার মিলিত মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ফলেই সুপারটাইডের সৃষ্টি হয়। এই জোয়ারের উচ্চতা দাঁড়ায় ৪৬ ফুট, যা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। চারতলা ভবনের সমান এ জোয়ারকে প্রলয়ঙ্কর মনে হলেও অনেক ভ্রমণপিপাসুর কাছে সেটি এক স্বর্গীয় অনুভূতি।
১৭ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ক্ষুদ্র এই দ্বীপটিকে ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত দেয়। পশ্চিমা বিশ্বের আশ্চর্য নামে পরিচিত আশ্রমটি ৭০৯ সালে একটি উপকূলীয় পাহাড়ের ওপর নির্মিত হয়েছিল। ১১ থেকে ১৬ শতকের মধ্যে বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি পবিত্র স্থান হয়ে ওঠে। এটি ফ্রান্সের বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষীও। শতবর্ষী যুদ্ধের সময় বহুবার চেষ্টা করেও এই দ্বীপটিকে কোনোভাবেই দখলে নিতে পারেনি ইংরেজরা। ১৮ শতকে ফরাসি বিপ্লবের সময় এটিকে একটি কারাগারে পরিণত করা হয়েছিল।
১৮৬৩ সাল নাগাদ সেখানে ১৪ হাজার বন্দিকে আটকে রাখা হয়। ভয়ংকর জোয়ার ও চোরাবালির কারণে সেখান থেকে বন্দিদের পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল। কালের পরিক্রমায় এমনই বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে দ্বীপটি আজও দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের বুকে। জানান দিয়ে যাচ্ছে নিজের স্বতন্ত্র পরিচয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকে দ্বীপটি বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের আকর্ষণ করতে শুরু করে। এটি এখন প্যারিসের বাইরে ফ্রান্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্যগুলোর একটি। প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ পর্যটক দুর্গটি পরিদর্শন করেন।
চলতি মাসের শুরুতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ আশ্রমটি পরিদর্শনের পর টুইটারে লেখেন, মন্ট সেন্ট-মিশেল হাজার বছরের ফরাসি সর্বজনীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই মঠ, আমাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির প্রতীক। এ থেকে বোঝা যায় আমরা নির্মাণশিল্পী।
মঠটি নির্মাণের বার্ষিকী উদযাপনে আগামী ২৩ জুন ‘মিলেনিয়াম সলস্টিস’ নামে একটি কনসার্ট, কনফারেন্স ও একটি ভিজ্যুয়াল শোর আয়োজন করা হয়েছে। এদিন দর্শনার্থীরা মঠটিতে অভূতপূর্ব লাইট শো দেখতে পাবেন। এ ছাড়া আগামী নভেম্বর পর্যন্ত আশ্রমের ইতিহাস ও স্থাপত্য সম্পর্কে প্রদর্শনীও উপভোগ করতে পারবেন পর্যটকরা। সিএনএন।
অতিরিক্ত পর্যটকের কারণে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে বলেও জানিয়ে আসছেন পরিবেশবাদীরা। পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখার প্রয়াসে সেখানে যাতায়াত করা বাসগুলো ডিজেলের পরিবর্তে জৈব জ্বালানিতে চলে। মৌসুমভিত্তিক দিনের নির্দিষ্ট সময়েই কেবল পর্যটকরা মন্ট সেন্ট-মিশেল ঘুরে দেখতে পারেন। তথ্যসূত্র: সমকাল
পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ