এক সময় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু হওয়ার খবর ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক ঘটনা। সুখবর হচ্ছে, দেশে দিনদিন মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই কমছে। যেখানে স্বাধীনতার সময়ও সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি লাখে ৬শ’র কম-বেশি মায়ের মৃত্যু হতো, সেখানে সরকারি হিসেবে এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬৪ জনে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা প্রতি লাখে ৭০ এর নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশকে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। আগামী সাত বছরের মধ্যে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া অনেকটাই কঠিন। অবশ্য গাইনি চিকিৎসকরা বলছেন, গর্ভবতী নারীদের মাতৃত্বকালীন সাতটি উল্লেখ্যযোগ্য জটিলতার সমাধান করা গেলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা যাবে মাতৃমৃত্যুর হার। এজন্য গর্ভধারণের শুরু থেকে নিরাপদ প্রসব পর্যন্ত গর্ভবতী নারীর কমপক্ষে চারবার স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে। প্রসূতি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, একজন গর্ভবতী মাকে গর্ভধারণ থেকে প্রসব হওয়া পর্যন্ত কমপক্ষে চারবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া প্রয়োজন। ফলে গর্ভাবস্থায় কোন জটিল সমস্যা থাকলে সেটি সহজেই চিকিৎসকের দ্বারা দূর করা সম্ভব হয়ে ওঠবে। না হয় জটিলতা তৈরি হয়ে মায়ের মৃত্যু হতে পারে।
এ জন্য গর্ভধারণের ১৬ সপ্তাহের সময় প্রাথমিক শারীরিক পরীক্ষা করা জরুরি। পরবর্তীতে ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহে দ্বিতীয়বার, ৩২ সপ্তাহে তৃতীয়বার এবং ৩৬ সপ্তাহে চতুর্থবার গর্ভবতী নারীকে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের গাইনি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার বলেন, ‘লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে হলে সবাইকে নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে। এখনো অনেক গর্ভবতী নারী কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা গর্ভকালে বা প্রসবের সময় চিকিৎসকের কাছে আসতে চান না।
তাদের মনে ভ্রান্ত ধারণা থাকে, হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে গেলেই হয়তো সিজার করানো হবে। যার কারণে গ্রামাঞ্চলে এখনো বাড়িতেই প্রসব করানোর চেষ্টা করা হয়। মনে রাখতে হবে গর্ভে সন্তান আসার আগে যেভাবে একটি পরিবার পরিকল্পনা করা হয়, সে পরবর্তী সময়েও পরিকল্পনা অনুযায়ী চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই লক্ষ্যমাত্রার আগেই মাতৃমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে।’
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) এক গবেষণায় বলা হয়, দেশে মাতৃমৃত্যু হারের কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩১ শতাংশ রক্তক্ষরণে হয়। এছাড়া একলামশিয়া (খিঁচুনি) ২৪ শতাংশ, পরোক্ষ কারণে ২০ শতাংশ, অনির্ধারিত কারণে ৮ শতাংশ, গর্ভপাত জটিলতায় ৭ শতাংশ, অন্যান্য কারণে ৭ শতাংশ এবং অমানসিক শ্রমে ৩ শতাংশ মৃত্যু হয়।
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ চিকিৎসকদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল এন্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কামরুন নেসা রুনা বলেন, ‘গর্ভধারণ কোনো অসুস্থতা নয়। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে একজন মায়ের মৃত্যুও কাম্য নয়। তবুও যে মৃত্যুগুলো হচ্ছে, তারমধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও একলেমশিয়া বা খিঁচুনি হওয়া। এ দুই কারণেই বর্তমানে প্রায় ৫৫ শতাংশের মৃত্যু ঘটে। অবশ্য এসব বিষয়ে এবং মা ও শিশু মৃত্যুরোধ এবং তাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার পাশাপাশি এসব সমস্যা প্রতিরোধ করার প্রত্যয় নিয়ে সরকারের সাথে একযোগে ওজিএসবিও কাজ করে যাচ্ছে।’
পূর্বকোণ/পিআর