চট্টগ্রাম রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ ও তার প্রতিকার

২৫ মে, ২০২৩ | ২:৫৭ অপরাহ্ণ

জান্নাতুল ফেরদৌস, বয়স ২৩ বছর। বিয়ে হয়েছে তিন বছর হলো। স্বামী, সংসার নিয়ে ভালোই চলছিলো, কিন্তু বিয়ের পর প্রতিটি নারীর আকাঙ্ক্ষা একটি সন্তান। অনেক চেষ্টা করেও সে আশায় গুড়েবালি। বিষন্নতা পেয়ে বসলো, সাথে যোগ হলো শাশুড়ির আক্ষেপ, হতাশাব্যাঞ্জক কথার আঘাত। সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকে জান্নাত। তার এই বিষন্নতা স্বামীর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। নানাভাবে স্ত্রীকে খুশি করার চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হলেন, তখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে ধরা পড়লো, সে থাইরয়েড হরমোনজনিত রোগে ভুগছেন, যা ছিলো হাইপোথাইরয়ডিসম বা থাইরয়েড হরমোন স্বল্পতা। অতঃপর চিকিৎসা শুরু হলো। এদিকে শাশুড়ী বেকে বসলেন, বৌমার হরমোন রোগ ধরা পড়েছে, এর মানে হল, তার আর বাচ্চা হবে না। নেমে এলো বৌয়ের উপর মানসিক নির্যাতন এবং ছেলেকে পুনরায় বিয়ে করানোর তোড়জোড়। এ অবস্থায় জান্নাতের মানসিক অবস্থা নিঃশ্চই বুঝতে পারছেন? এ রকম জান্নাত আমাদের চারপাশে হাজারো ছড়িয়ে আছে, যাদের কান্না আমাদের কানঅব্দি পৌঁছায় না। এই সমস্যা ডাক্তারের চেম্বারে আমরা প্রায়শই দেখি। এর সমাধান করতে হলে, আমাদের থাইরয়েড হরমোন সম্পর্কে কিছু বিষয় জানা থাকতে হবে। প্রচলিতভাবে হরমোন রোগ বলতে আসলে অনেক রকম হরমোনের রোগকে বোঝানো হয়, কেননা আমাদের শরীরে বেশকিছু হরমোন আছে, যাদের মধ্যে থাইরয়েড হরমোন অন্যতম। আমাদের গলায় শ্বাসনালীর সামনের দিকে প্রজাপতির মতো একটি গ্রন্থি আছে, যা থাইরয়েড গ্রন্থি নামে পরিচিত। এই গ্রন্থি থেকে থাইরক্সিন T4 ও ট্রাই-আয়োডো থাইরনিন T3, নামের হরমোন নিঃসৃত হয়, যা আমাদের বিপাক ক্রিয়াসহ শারীরিক ও মানসিক বৃদ্বিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। থাইরয়েড গ্রন্থির হরমোন নিঃসরণ পরিচালনা করে TSH নামক হরমোন, যা মস্তিস্কে অবস্থিত পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে আসে। পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের TSH নিঃসরণ পরিচালিত হয় হাইপোথ্যালামাস থেকে নিঃসৃত TSH হরমোন এর মাধ্যমে। কাজেই এই তিন গ্রন্থির যে কোন একটিতে সমস্যা দেখা দিলে, থাইরয়েড হরমোনজনিত রোগ দেখা দিতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যাই দায়ী।

সচরাচর থাইরয়েড গ্রন্থির যে রোগ গুলো দেখা যায়, সেগুলো হলো- হাইপোথাইরয়ডিসম, অর্র্থাৎ শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় হরমোন উৎপাদন কমে যাওয়া। হাইপারথাইরয়ডিসম-প্রয়োজনের তুলনায় বেশী হরমোন তৈরি হওয়া। থাইরয়ডাইটিস-থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের প্রদাহ। থাইরয়েড নডিউল-গ্ল্যান্ডের টিউমার, যা ভালো (Begin) বা খারাপও (Malignant) হতে পারে। এছাড়া যে কোন কারণে থাইরয়েড গ্রন্থি আকারে বড় হয়ে যেতে পারে, যাকে আমরা গয়টার (Goiter) বা গলগন্ড বলি। এক্ষেত্রে হরমোনের তারতম্য থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। থাইরয়েড গ্রন্থির রোগগুলোর অন্যতম কারণ হলো, অটো ইমিউনিটি বা শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন নিজের বিরুদ্ধেই কাজ করে, তাছাড়া আয়োডিনের অভাব, বা আধিক্য, গ্রন্থির প্রদাহ, বা কিছু কিছু ঔষধ সেবনের মাধ্যমেও এ রোগ হতে পারে।

হাইপোথাইরয়ডিসম বা হরমোন কমে যাওয়ার লক্ষণগুলো হলো, ক্লান্তি বা অবসাদ, শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া, সারা গায়ে ব্যাথা অনুভূত হওয়া, ঠান্ডা সহ্য করতে না পারা, কোষ্ঠ-কাঠিন্য, শুষ্কত্বক, অত্যধিক ঘুম ঘুম ভাব, বিষণ্নতা, মহিলাদের অনিয়মিত ঋতুশ্রাব ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, এমনকি বন্ধ্যাত্ব ও হতে পারে, যা আমাদের গল্পের শুরুতেই বলেছি। অনেকের শরীরে পানি আসে, পা ফুলে যেতে পারে। গর্ভকালীন সময়ে যদি বাচ্চার থাইরয়েড গ্রন্থি অনুপস্থিত থাকে, বা ভালোভাবে তৈরি না হয়, অথবা তৈরি হওয়া সত্বেও হরমোন উৎপাদনের ক্ষমতা না থাকে, তবে বাচ্চাদের জন্মগতভাবেই হাইপোথাইরয়ডিসম থাকতে পারে। এ রোগে বাচ্চার শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয় এবং বাচ্চা খর্বকায় হয়। দ্রুত রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা যায়, ততই ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

হাইপারথাইরয়ডিসমে উল্টো ঘটনা ঘটে, যেখানে অতিরিক্ত হরমোন তৈরি হতে থাকে। শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি গ্রন্থিতে টিউমার থাকলেও এই রোগটি হতে পারে। এ রোগের লক্ষণগুলো হচ্ছে, ঠিকমত খাওয়া সত্বেও শরীরের ওজন দিন দিন কমে যাওয়া, বুক ধরফর করা, অতিরিক্ত ঘাম, দুর্বলতা, সামান্য পরিশ্রমেই হাপিয়ে উঠা, গরম সহ্য করতে না পারা, অস্থিরতা, ঘন ঘন পায়খানা হওয়া, মহিলাদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত ঋতুশ্রাব এমনকি বন্ধ্যাত্বও হতে পারে। অনেকের চোখ বড় হয়ে অক্ষিকোটর থেকে কিছুটা সামনের দিকে বেড় হয়ে আসে, এতে চোখ লাল হয়ে যাওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া, ব্যাথা অনুভূত হওয়া এমনকি চোখে দেখতে অসুবিধা, যেমন কোন জিনিসকে দ্বিগুণ দেখা যাওয়াসহ মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। থাইরয়েড গ্রন্থির প্রদাহ হলে, হালকা বা মাঝারি জ্বর, গলাব্যাথা ও উপরে উল্লেখিত হরমোন আধিক্যের লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। টিউমার হলে থাইরয়েড গ্রন্থির আকার বড় হবে। টিউমার এক বা একাধিক হতে পারে। টিউমার থেকে অতিরিক্ত হরমোন নিঃসৃত হয়ে হাইপারথাইরয়ডিসম এর লক্ষন দেখা দিতে পারে। তবে হরমোন স্বাভাবিক বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমও দেখা যেতে পারে। রোগ শণাক্তের জন্য রক্ত পরীক্ষা করে, রক্তে TSH ও থাইরয়েড হরমোনগুলো FT3, FT4 দেখা হয়। গ্রন্থির গঠন ও কার্যকারিতায় সমস্যা আছে কিনা, তা দেখার জন্য থাইরয়েড আলট্রাসনোগ্রাফি ও থাইরয়েড স্ক্যান করা হয়। এছাড়া কিছু এন্টিবডির উপস্থিত আছে কিনা দেখে রোগের ধরণ ও প্রকৃতি নির্ণয় করা হয়। টিউমার থাকলে সুই দিয়ে পরীক্ষা করে (FNAC) দেখতে হয়, এটি ভালো নাকি খারাপ টিউমার? বলে রাখা ভালো, থাইরয়েডের টিউমার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভালো হয়। কিন্তু তা অবশ্যই সুই দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে, কেননা, খারাপের সম্ভাবনা কিছুটা হলেও থেকে যায়। রোগের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা নির্ধারণ করতে হয়। হরমোন কম থাকলে উক্ত হরমোন ঔষধের মাধ্যমে সারাজীবন সেবন করতে হয়। হরমোনের আধিক্য থাকলে তা ঔষধ, রেডিও আয়োডিন বা অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়, তবে রোগের কোন পর্যায়ে কি চিকিৎসা লাগবে, সেটা রোগের মাত্রা দেখে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, অর্থাৎ হরমোন রোগের চিকিৎসক সিদ্ধান্ত দিবেন। টিউমার যদি খারাপ প্রকৃতির হয়, তবে তা অতিসত্বর অপারেশন করে ফেলতে হবে। অপারেশনের পর টিউমারটি পরীক্ষা করে (Histopathology) চিকিৎসার পরবর্তি ধাপগুলো ঠিক করা হয়।

আমাদের দেশে প্রায় ৫ কোটির ও বেশী মানুষ থাইরয়েডজনিত সমস্যায় আক্রান্ত, যার প্রায় ৩ কোটিই জানে না যে তাদের এই রোগটি আছে। পুরুষের তুলনায় নারীদের এই রোগের প্রকোপ বেশী। সাধারণত একজন পুরুষের বিপরীতে দশজন নারী থাইরয়েডজনিত রোগে আক্রান্ত। প্রাপ্তবয়স্ক ২ শতাংশ মহিলা ও ০.২ শতাংশ পুরুষ হাইপারথাইরইডিসম (হরমোন আধিক্য) এবং ৩.৯ শতাংশ পুরুষ ও ৯.৪ শতাংশ মহিলা হাইপোথাইরয়ডিসম (হরমোন স্বল্পতা) এ আক্রান্ত। সাধারনত ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা দেয়। তাই বিয়ের আগে বা গর্ভধারনের পূর্বে একজন নারীকে অবশ্যই থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা করে দেখতে হবে। বাংলাদেশে আয়োডিনের ঘাটতি এবং এন্টিবডি উপস্থিতির আধিক্যের কারণে এ অঞ্চলে থাইরয়েড রোগের প্রকোপ বেশি বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। নবজাতকেরও হরমোন ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যা প্রতি ১০ হাজার জীবিত নবজাতকের জন্য ২.৮ প্রায়। এতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যহত হতে পারে। মহিলাদের ক্ষত্রে একটি হতাশার কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, যেহেতু হরমোনের রোগ আছে, সেহেতু তার পক্ষে গর্ভধারন কখনোই সম্ভব নয়। যেমনটা হয়েছে জান্নাতের শাশুড়ী র ক্ষেত্রে। কিন্তু এটি একেবারেই ভুল ধারনা। সাধারণত থাইরয়েড হরমোনের তারতম্য, মহিলাদের ডিম্বস্ফুটনের ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে গর্ভধারন কঠিন করে তুলতে পারে। ডিমের গুনগত মানেরও ত্রুটি দেখা যায়। আবার গর্ভধারন হয়ে থাকলেও, গর্ভপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়, এমনকি সন্তানের জন্মগত ত্রুটি ও বুদ্ধিমত্তা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু এতে ভয় পাওয়ায় বা হতাশ হবার কিছু নেই। সঠিক সময়ে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে ঔষধ সেবন করে গর্ভধারনের পূর্বেই হরমোনের মাত্রা এমন পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে, যা গর্ভকালীন হরমোনের নির্ধারিত মাত্রার মধ্যে থাকে। তাই আজকাল থাইরয়েড হরমোনের পরীক্ষাকে বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে রুটিন পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।

পরিশেষে বলবো, দুঃচিন্তা নয়, থাইরয়েডজনিত উপসর্গ দেখা দিলে, অবহেলা না করে তৎক্ষণাৎ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন। কেননা, এ রোগের আধুনিক চিকিৎসা আমাদের দেশেই আছে। এর জন্য বিদেশ যাবার প্রয়োজন নেই। থাইরয়েড গ্রন্থি যদিও আকারে ছোট, এর কার্যকারিতা ব্যাপক। ভ্রুন অবস্থা থেকে আমৃত্যু থাইরয়েড হরমোন অপরিহার্য। তাই এ রোগ সম্পার্কে প্রাথমিক জ্ঞান ও সচেতনতার মাধ্যমে এ গল্পের জান্নাতের মত হাজারো জান্নাতের জীবনকে সহজ ও উপভোগ্য করা অসম্ভব নয়।

ডা. ফারহানা আক্তার, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।

পূর্বকোণ/এ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট