চট্টগ্রাম শনিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

‘দ্য ল্যানসেট’ জার্নালের শোক জ্ঞাপন

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কোনো চ্যালেঞ্জেই পিছপা হননি

২৩ মে, ২০২৩ | ৮:৫৬ পূর্বাহ্ণ

তিনি ছিলেন একাধারে একজন সার্জন, জনস্বাস্থ্য কর্মী এবং স্বাস্থ্য-সমতার অগ্রদূত। ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১ সালে বাংলাদেশের রাউজানে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ৮১ বছর বয়সে ১১ এপ্রিল, ২০২৩-এ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের জটিলতায় মারা যান।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্য কোনো চ্যালেঞ্জই অনতিক্রম্য ছিল না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গেরিলা যোদ্ধা ও ডাক্তার হিসেবে যোগদানের জন্য তিনি ডাক্তারিতে উচ্চতর পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ (জিকে) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেটা বাংলাদেশে কমিউনিটি স্বাস্থ্য পরিষেবার পুনঃপ্রবর্তন এবং নারী স্বেচ্ছাসেবকদের অবস্থান সমুন্নত করেছিল।
তিনি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর ‘ওষুধের চড়া মূল্য’কে চ্যালেঞ্জ করেছেন, শিক্ষাগত সেবা সম্প্রসারণের জন্য সরকারকে চাপ দিয়েছেন এবং এমনকি যখন তিনি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তখনও বাংলাদেশে কম খরচে কিডনি ডায়ালাইসিসের সার্বজনীন সুবিধার পক্ষে কথা বলেছেন। হেলথ অ্যাকশন ইন্টারন্যাশনাল (এইচএআই) এশিয়া প্যাসিফিকের অনারারি কো-অর্ডিনেটর বেভারলি স্নেল যথার্থই বলেছেন, ‘তাঁর ‘দায়িত্ব’ নেবার যেন কোনো শেষ নেই; কোথাও অন্যায় হলেই তিনি সেখানে আছেন।’
জনাব চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন, কিন্তু এটি তাকে প্রতিষ্ঠানের মধ্যস্থিত দুর্নীতি প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তাঁর সেই সময়ের সহপাঠী আবুল কাসেম চৌধুরী বলছিলেন, ‘তিনি বলেছিলেন আমাদের কিছু করতে হবে, ব্যাস, সেখানকার সমস্যার বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি।’
যাক, ১৯৬৪ সালে এমবিবিএস শেষ করে তিনি ‘সাধারণ ও ভাস্কুলার’ সার্জারিতে স্নাতকোত্তর অধ্যয়নের জন্য যুক্তরাজ্যে চলে যান। কিন্তু তার পড়াশোনা শেষ হবার আগেই প্রাক্তন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং তিনি পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী যোদ্ধাদের সাথে যোগ দিতে ফিরে আসেন, যারা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা লাভ করে।
এইচএআই’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা (ডা, জাফরুল্লাহ চৌধুরীও ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য) ও আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজ কর্মী আনোয়ার ফজল বলছিলেন, ‘যুদ্ধে তাকে বরাবর সম্মুখসারিতেই থাকতে হয়েছিল।’ সেখানে তিনি তার চিকিৎসা দক্ষতা কাজে লাগান-আহত যোদ্ধা এবং অসুস্থ উদ্বাস্তুদের চিকিৎসার জন্য একটি ৪৮০-শয্যার হাসপাতাল নির্মাণে সাহায্য করে।
‘সেই অভিজ্ঞতা তাকে দরিদ্রদের অবস্থা সম্পর্কে খুব স্পষ্ট ধারণা দিয়েছিল’, বলছিলেন আবুল কাশেম চৌধুরী। এই আবুল কাশেম চৌধুরী পরে জিকে’র নির্বাহী পরিচালক এবং গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং এখন তিনি জিকে-এর একজন ট্রাস্টি।
যুদ্ধ শেষে সাভারের গ্রামীণ এলাকায় জিকে-এর ঠিকানা হয়। উদ্যোক্তারা একে একটি ‘পরীক্ষামূলক প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা প্রকল্পে’ রূপান্তর করেন। জনাব চৌধুরী সেখানে প্যারামেডিক হিসাবে কাজ করার জন্য ‘কোনও চিকিৎসা পটভূমি নেই’ এমন স্থানীয় মহিলাদের নিয়োগ করেন ‘প্রতিষেধক এবং নিরাময়মূলক’ ট্রেনিং দিয়ে।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে এই প্যারামেডিক মডেলটি গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর ওষুধের দাম বাংলাদেশের গ্রামীণ দরিদ্রদের নাগালের বাইরে ছিল; কিন্তু জনাব চৌধুরী তার নিজস্ব জেনেরিক ওষুধ কোম্পানি স্থাপন করে ওষুধের দাম কমাতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারকে এমন আইন প্রণয়নের পরামর্শ দেন, যা অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের কোডিফাই করবে এবং অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকারক ওষুধের বিক্রি নিষিদ্ধ করবে। তিনি এমনকি ডব্লিউএইচওকেও একটি অপরিহার্য ওষুধের তালিকা তৈরি করার জন্য চাপ দেন, যা সংস্থাটি প্রথম ১৯৭৭ সালে প্রকাশ করেছিল।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী সমাজে একজন যুগোপযোগী পথপ্রদর্শক ছিলেন। তার জিকে ১৯৭৩ সালে একটি গ্রামীণ স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা চালু করে। তাছাড়া বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ১৮৭টি স্কুল, সাভারে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, গণবিশ্ববিদ্যালয়, একটি কারিগরি কলেজ এবং একটি স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে। তার বরাবরকার বিশ্বাস ছিল, ‘যতক্ষণ না মানুষকে শিক্ষিত করা সম্ভব হবে, তাদের অবস্থার উন্নতি করাও হবে খুব কঠিন।
জনাব চৌধুরীর বিশ্বব্যাপী প্রভাবও ছিল ঈর্ষনীয়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে আয়োজিত প্রায় দেশি-বিদেশি ২০০০ ডেলিগেটের উপস্থিতির সমাবেশে তারই প্রস্তাবিত মডেল অনুযায়ী জন্ম হয় ‘পিপলস হেলথ মুভমেন্ট’ (পিএইচএম)-এর।
তার অনেক অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, ১৯৮৫ সালের র‌্যামন মেগসেসে পুরস্কার এবং ১৯৯২ সালের রাইট লাইভলিহুড এওয়ার্ডসহ আরো অনেক পুরস্কার লাভ করেন।
তিনি স্ত্রী শিরীন হক, মেয়ে বৃষ্টি চৌধুরী, ছেলে বারেশ হাসান চৌধুরী, চার বোন ও চার ভাই রেখে গেছেন।
‘প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং দরিদ্রের জন্য স্বাস্থ্যের ন্যায়বিচারের একজন অগ্রদূত ছিলেন তিনি।
তিনি সততা, ক্ষমতার সাথে সত্য কথা বলার এবং একটি উন্নত বিশ্বের প্রতি অঙ্গীকারের উত্তরাধিকার রেখে গেছেন, যা থেকে আমরা সবাই শিখতে পারি। [অনূদিত]
(অ্যান্ড্রগ্রিন, দ্য ল্যানসেট, ২০ মে ২০২৩)

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট