
নাজিম মুহাম্মদ
নগরীর মুরাদপুর এলাকায় সড়কের দুই থেকে তিন ফুট দূরত্বে চার ফুট বাই ছয় ফুট আকারের ছোট টং দোকান। নাম মক্কা মোটরস। ছোট এই দোকানের ছাদে ও দেয়ালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সরঞ্জাম। মাটিতে ডালা সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা সাইজের নাটবল্টু। ওই দোকানের এক পাশে হিসাব কষছেন কর্মচারী মো. জসিম। হিসাবের ফাঁকে মুঠোফোনেও কথা চলছিল তার। যেনো দম ফেলার ফুরসত নেই। কথা বলতেই জসিম জিজ্ঞেস করলেন, ভাই কী চাইছিলেন?
জসিম জানান, পিকআপ, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, জীপ গাড়ি এমনকি জাহাজের নাটবল্টু রয়েছে তার দোকানে। রিকন্ডিশন্ড (পুরনো) গাড়ির নালবল্টু ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন গাড়ি মেরামতের জিনিসপত্র। তার সাথে কথা বলতেই এক ক্রেতা দোকানে আসেন হাই সুপার ক্লাস বুস্টারের পার্টসের সন্ধানে।
মুরাদপুরের পুরনো পার্টসের এসব দোকানে নাটবল্টু ছাড়াও গাড়ির পুরনো লাইট, আয়নাম বিয়ারিং, পাখা, স্প্রিং, ব্রেক, বুস্টার, হ্যাঙ্গার, হুইল, টায়ার সবই চাহিদা অনুযায়ী স্বল্প দামে পাওয়া যায়। দেশের গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এখানকার দোকান ও ব্যবসা সমানতালে বেড়েছে। সড়কের একাংশ ও ফুটপাত ছাড়িয়ে এসব যন্ত্রাংশের দোকান গড়ে ওঠেছে বিভিন্ন অলি-গলিতে। অধিকাংশ দোকান আকারে এত ছোট যে এসব দোকানের মালামাল যততত্র দখল করে নিয়েছে ফুটপাত ও সড়কের একাংশ। ফলে সংকুচিত ফুটপাত ঘেঁষেই হাঁটতে হয় পথচারীদের। এসব দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেই মালিক ও শ্রমিকদের হাঁকডাক শোনা যায়।
দেশে চলাচল করা পুরনো গাড়ি এবং তার যন্ত্রাংশ ছাড়াও আমদানি করা পুরনো যন্ত্রপাতি এখানে বিক্রি হয়। এসব যন্ত্রাংশের ব্যবহার উপযোগী জিনিসগুলো খুঁজে বের করেন শ্রমিকরা। তাৎক্ষণিকভাবে সেসবের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নেন তারা। সকাল থেকে শুরু হওয়া এসব দোকান জমজমাট থাকে রাত পর্যন্ত।
এলাহী পার্টসের দোকানের সামনে ফুটপাতের ওপর ফেলে রাখা হয়েছে গাড়ির পুরনো ইঞ্জিন। নিখুঁত হাতে সে ইঞ্জিন থেকে নালবল্টু বের করার কাজ করছিলেন দোকানের কর্মচারী মো. সোহেল। তার পাশে বের করে আনা প্রয়োজনীয় নাটবল্টু আলাদা করছিলেন সুমন। তার হাতে আর পরনের প্যান্টে কালির দাগ। স্বল্প সময়ের মধ্যে কাজগুলো সারছিলেন তারা। বাছাই করা নাটবল্টু দোকানের মহাজনের হাত বদল হয়ে চলে যাচ্ছে আশেপাশের ছোট ও মাঝারি দোকানে। আর স্ক্র্যাপ যন্ত্র (ব্যবহার অনুপযোগী) কেজি ৪৭ টাকা দরে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন রড নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। রিকন্ডিশন কোনো যন্ত্রাংশের প্রয়োজন পড়লেই ক্রেতাদের দ্বারস্থ হতে হয় এসব দোকানে।
চাহিদার সঙ্গে বেড়েছে দোকানের সংখ্যা
একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সৈন্যদের ব্যবহার করা বিভিন্ন যানবাহনের মালামাল নিলাম থেকে কিনে নেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। পরবর্তীতে স্থানীয় চাহিদার সাথে সমন্বয় করতে শুরু হয় এসব গাড়ির ইঞ্জিন এবং পার্টসের ব্যবসা। পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি ব্যবসায়ীরা এই ব্যবসার প্রসারে এগিয়ে আসেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাঙালিদের হাতে পুরনো যন্ত্রাংশের ব্যবসার আধিপত্য চলে আসে। বর্তমানে চট্টগ্রামসহ দেশের পুরনো যন্ত্রাংশের ব্যবসার নেতৃত্ব দিচ্ছে এখানকার ব্যবসায়ীরা। মুরাদপুর থেকে বিবিরহাট এলাকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ৬০০ এর অধিক পুরনো যন্ত্রাংশে দোকান। আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক মিলে তিন হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে এখানে। মাসে ২৫ কোটি টাকার বেশি ব্যবসা হয় বলে জানান এখানকার ব্যবসায়ীরা।
দেশের পুরাতন পার্টসের অনত্যম পুরনো বাজার ঢাকার ধোলাইখালে এখান থেকে যন্ত্রাংশ পাঠানো হয়। এছাড়া সিলেটের মৌলভীবাজার, যশোর, কুমিল্লা, কক্সবাজার, নোয়াখালীতে সর্বাধিক পুরনো যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা হয়। চট্টগ্রামের মধ্যে নগরের কদমতলী, ভাটিয়ারী এবং চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলার চাহিদা মেটাচ্ছে এখানকার মালামাল।
১৯৮০ সালের শুরুতে মুরাদপুরে রিকন্ডিশন যন্ত্রাংশের ব্যবসা শুরু করেছিলেন মেসার্স খাজা এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার নুর আহামদ। সময়ের পরিক্রমায় তার ছেলে মো. ইমরান আজ এই ব্যবসার হাল ধরেছেন। বর্তমানে নুর আহমেদ দুবাইয়ে অবস্থান করে পুরনো পার্টস দেশে সরবরাহ করছেন।
তার ছেলে ইমরান বলেন, ১৯৮০ সালের দিকে এখানে হাতে গোনা কয়েকটি দোকান ছিল। দুবাই থেকে তখন গাড়ির যন্ত্রাংশ আসতো। ছোটখাটো পুঁজি নিয়ে তার বাবা ব্যবসা শুরু করেন। দেশে বিভিন্ন গাড়ি আমদানি শুরু হলে যন্ত্রাংশের চাহিদার সঙ্গে ব্যবসার প্রসার লাভ করে। ব্যবসায়ীরা আমদানিতে ঝুঁকে পড়েন। শহরের দেওয়ানহাট এলাকায় এই ব্যবসা শুরু হয়। করোনায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হলেও এখন ভালোই ব্যবসা চলছে। মাসে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা আয় হয়।
বংশ পরম্পরায় চলছে ব্যবসা
বর্তমানে জাপানি গাড়ির পুরাতন ইঞ্জিন দুবাই থেকে বন্দর দিয়ে আমদানি করে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। একটি কনটেইনারে ৭০ থেকে ৮০ টন যন্ত্রাংশ আনতে খরচ পড়ে ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা। আমদানিকারকদের চাহিদা অনুযায়ী অর্ডারের যন্ত্রাংশ আসতে এক মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। ক্ষেত্রবিশেষে কিছু ভারতীয় গাড়ির যন্ত্রাংশ আনেন আমদানিকারকরা। কয়েক যুগ ধরে এ ব্যবসা চলে আসলেও পায়নি প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পের ছোঁয়া। এ নিয়ে ক্ষোভের অন্ত নেই এখানকার ব্যবসায়ীদের। বংশ পরম্পরায় এসব ব্যবসার হাল ধরেছেন তরুণরা ব্যবসায়ীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, সাত লাখ টাকায় কেনা একটি জাপানি গাড়ি কয়েক বছর ব্যবহারের পর সেটির যন্ত্রাংশ আট থেকে নয় লাখ টাকায় বিক্রি করা যায়। কিন্তু কম দামের সুবিধা নিতে ভারতের কেনা তিন লাখ টাকার একটি গাড়ি আড়াই বছর পর আর ব্যবহার করা যায় না। ওই সব গাড়ির যন্ত্রাংশ অকেজো হয়ে পড়ে। এরপরও সরকার ভারতীয় শিল্পকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে সেখান থেকে গাড়ির পার্টস আমদানি করতে চাইছে। দেড়শ’র বেশি আমদানিকারক এখানকার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করলেও সরকারকে এটি বোঝাতে পারছে না। এতে করে অনেকে বিনিয়োগের উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। ব্যবসায়ীদের দাবিকে গুরুত্ব দিতে আমরা আহŸান জানাব।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দেশে দুই টনের গাড়িতে পাঁচ থেকে সাত টনের মালামাল নেওয়া হয়। পণ্যবোঝাই মালামাল বহন করতে ভারী যানবাহনের প্রয়োজন হয়। আমাদের সড়কগুলোতে ভারতের এসব পরিবহন মালামাল বহন করতে পারছে না। মাঝপথে বিকল হয়ে যাচ্ছে। আমরা তরুণ ব্যবসায়ীরা দাবি করব দ্রুত ও ভালো সার্ভিস দিতে জাপানের গাড়িগুলো আমদানি করার।
লোকসান গুনছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা
এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ততা বাড়লেও আমদানিতে খরচ বেড়েছে বলে জানালেন মেসার্স আবুল খায়ের মোটরসের স্বত্বাধিকারী মুহাম্মদ শাহাদাত। তিনি বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার পর দুবাইয়ের দিরহামের মুদ্রার দামও বেড়েছে। ফলে পুরাতন যন্ত্রাংশের বাজারের মধ্যে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান আফ্রিকাসহ আরও কয়েকটি দেশে আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। যেসব ব্যবসায়ী আগে পেমেন্ট করছেন তারা আগে মাল পাচ্ছেন। এই সুযোগে কম দামে ঢাকার ধোলাইখালের ব্যবসায়ীরা বাজার দখল করে নিচ্ছে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা চাহিদা মতো মাল না পাওয়া লোকসান গুনছেন।
লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক
পূর্বকোণ/এসি