চট্টগ্রাম রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

নৈতিকতার অবক্ষয়ে বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা

ডা. মো. ওমর ফারুক

১৯ জুলাই, ২০১৯ | ১:০২ পূর্বাহ্ণ

নয়ন বন্ড ও তার গ্যাং গ্রুপ ০০৭ কর্তৃক রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার দৃশ্য বিশ্ববিবেককে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে, এতে কোন বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে, শত শত রিফাত শরীফকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এভাবে অথবা অন্যভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়-যা সংবাদ মাধ্যমগুলোতে শুধুমাত্র সিঙ্গেল কলামে স্থান পায়-এই তো শেষ, আর কোন ফলোআপ নেই। এভাবেই রিফাত শরীফদের মৃত্যুর খবর ধামা চাপা পড়ে যায়, কারো মনে দাগ কাটে না কোনদিন। কিন্তু রিফাত শরীফ হত্যার দৃশ্য সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ার কারণেই হয়তো বা সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে চলে আসে খুব দ্রুত।
রিফাতকে ভাগ্যবান বলা যায় এ কারণে যে, রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তি তাঁর হত্যার বিচারের জন্য তদবির করেছেন পুলিশ প্রশাসনের কাছে। এভাবে যদি সব হত্যার আসামীদের ধরার জন্যে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সংস্থা থেকে তদবির করা যেত তাহলে বিচারের কিঞ্চিত আশা অন্তত পোষণ করতে পারতেন ভুক্তভোগীরা। এর মধ্যেই রিফাত হত্যার মূল আসামী নয়ন বন্ড নিহত হয়েছে এনকাউন্টারে বা ক্রসফায়ারে। নয়নের সেকেন্ড-ইন্-কমান্ড রিফাত ফরাজীকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে এবং এজাহারভুক্ত বেশ কিছু আসামীকে গ্রেফতার করতে পেরেছে পুলিশ প্রশাসন! পিটিয়ে হত্যা, কুপিয়ে হত্যা, গলা কেটে হত্যা, জবাই করে হত্যা, ছুরিকাঘাতে হত্যা, গুলিতে হত্যা- এগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের জন্য এখন কেমন যেন অতি সাধারণ সংবাদ হিসাবে প্রকাশ পাচ্ছে।
আমার আজকের আলোচনার পেছনে একটি বিশেষ বার্তা রয়েছে তাদের জন্যে- বখে যাওয়া তরুণ, কিশোর, যুবাদের অভিভাবকম-লী ও সংশ্লিষ্ট ভিক্টিম। আমরা সবাই এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাব এটা যেমন অমোঘ সত্য, তেমনি কখন চলে যাব সে ক্ষণটাও অনিশ্চিত সত্য। যদি আমরা এই বিশাল মহাবিশ্বের একচ্ছত্র রাজাধিরাজ, মহাপরাক্রমশালী, প্রবল ক্ষমতার অধিকারী মহান রাব্বুল আ’লামিনকে একক ও অদ্বিতীয় প্রভু হিসাবে মানি, তাহলে তাঁর প্রেরিত সর্বশেষ আসমানী কিতাব পবিত্র আল্-কোরআনকে জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে প্রতিষ্ঠা করা চাই, বুকে ধারণ করা চাই এবং সমগ্র মানবজাতির (রাহমাতুিল্লল আ’লামিন, রাহ্মাতুল্লিল মুসলিম নয়) মুক্তিদূত সর্বশেষ রাসূল ও নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর প্রদর্শিত আদর্শকে মানবজীবনে প্রতিষ্ঠা করা চাই।
মানুষের মৃত্যু যে অবধারিত সত্য তা পবিত্র কালামে পাকের অসংখ্য আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা আম্বিয়ার ৩৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলছেন, ‘প্রতিটি জীবকেই মরণের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, (হে মানুষ) আমি তোমাদের মন্দ ও ভাল উভয় অবস্থার মধ্যে ফেলেই পরীক্ষা করি, অতঃপর (তোমাদের তো) আমার কাছে ফিরিয়ে আনা হবে।’ সূরা আল্ ইমরানের ১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা, ‘প্রত্যেক প্রাণীই মরণের স্বাদ গ্রহণ করবে, তোমাদের পাওনা কেয়ামতের দিন পুরোপুরি আদায় করে দেয়া হবে, যাকে (জাহান্নামের) আগুন থেকে বাঁচিয়ে দেওয়া হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে; সেই সফলতা পাবে। (মনে রেখ) এই পার্থিব জীবন (কিছু বাহ্যিক) ছলনার মাল সামানা ছাড়া আর কিছুই নয়।’ আল্লাহ্র আয়াতগুলো এ আলোচনায় উদ্ধৃত করার উদ্দেশ্য হচ্ছে: কেউ আমরা এই দুনিয়ায় চিরদিন থাকব না- চলে যেতে হবে না ফেরার দেশে, যেখান থেকে কেউ আর কোনদিন ফেরে না। এই যে নয়ন বন্ড চলে গেল, রিফাত শরীফ চলে গেল, শত শত নয়ন-রিফাতকে এভাবে খুব অল্প বয়সেই করুণভাবে চলে যেতে হচ্ছে। কবর জীবনে তাদেরকে মুখোমুখি হতে হবে কঠিন বিচারের। কবরের ফেরেশ্তা (মুন্কার-নাকির) এর মুখোমুখি হতে হবে নয়ন বন্ডদের। সম্মানিত ফেরেশ্তাগণের প্রশ্নের জবাব কি দিতে পারবে নয়ন বন্ড? যখন বলা হবে মান রাব্বুকা? ওয়ামা দ্বিনুকা? ওয়ামান নাবিয়য়ুকা? অথবা আমাদের নবীজি (সা.)’র ছবি প্রদর্শন করে বলা হবে, ওনাকে চেনেন? প্রশ্ন শুধু প্রশ্নই থেকে যাবে-জবাব হয়তো মিলবে না। কারণ নয়ন বন্ডদের সাথে কোরআনের সাথে ছিল না কোনদিন গভীর আবেগ, গভীর ছোঁয়া-যে কোরআনের আয়াত আমাদের নবীজির উপর নাজিল হয়েছিল ঘোর আঁধার পাপাচারে নিমজ্জিত আরব দেশের হেরা গুহায়। নয়ন বন্ডদের পিতা-মাতা আল্লাহ্র আয়াতসমূহ কি তাদের হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়েছেন? ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার তাগিদ দিয়েছেন? শরীয়তের অন্যতম ফরজ বিধান নামাজের শিক্ষা দিয়েছেন? সৎ পথে চলার পরামর্শ দিয়েছেন? মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন?
এরকম হাজারও প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মানুষের মনে কিন্তু উত্তর মেলে না কারণ আমরা মানবজাতির সুষ্পষ্ট নিদর্শন আল্লাহর কোরআন থেকে যোজন যোজন দূরত্বে সরে গিয়েছি-আমার রাসূলের পবিত্র হাদিস থেকে সরে গিয়েছি সীমাহীন দূরে। যে নামাজের হিসাব প্রথমেই করা হবে কেয়ামতের দিনে, সে নামাজের হিসাবটি কি নয়ন বন্ডরা দিতে পারবে? কারণ, ‘নামাজ মানুষকে অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে (সূরা আল্-আনকাবুত-আয়াত ৪৫)’।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে, নয়ন বন্ডদের যারা পৃষ্ঠপোষকতা করছে তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেল। এদের নাম হয়ত কোনদিন পত্রিকায় ছাপা হবে না। নয়ন বন্ডকে ক্রসফায়ারের পর গডফাদারদের আর টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিশোর বয়সে মাদক সেবন, মাদক ব্যবসা, ইয়াবা সেবন, ইয়াবা ব্যবসা, ইভটিজিং, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণ- এসব যেন এ দেশের জন্য মামূলি ব্যাপার।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে এসব সংক্রমণ অতিমাত্রায় দেখা যাচ্ছে। শুধুমাত্র ছাত্ররাই নয়-স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক থেকে শুরু করে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, শিক্ষক, ইউপি সদস্য, ইউপি চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, সমাজকর্মী পর্যন্ত এসব অবৈধ কার্যক্রমে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে, যা দেশ ও জাতির জন্য সুখকর নয়। ইয়াবা ও ধর্ষণ এ দেশে যেন মহামারী রোগের মতন ছড়াচ্ছে। সাদামাটা কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, প্রত্যেকেরই যদি নিজ নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও নৈতিকতাবোধ থাকে, তাহলে এসব অপকর্ম করার ইচ্ছা কারো থাকবে না।
আমরা যদি প্রতিক্ষণে মৃত্যুকে স্মরণ করি ও দৈনন্দিন আল্লাহর কাছে ইস্তিগ্ফার করি তাহলে অন্যায় ও অপকর্ম করার বাসনা জাগার কোন সম্ভাবনা থাকবে না। আমাদের প্রিয় রাসূল (সা.) প্রতিদিন ৭০ বার ইস্তিগ্ফার করতেন। সূরা আহ্কাফের ৯ নম্বর আয়াতে মহান রাব্বুল আ’লামিন তাঁর প্রিয় হাবিবকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘তুমি বল, রাসূলদের মাঝে আমি তো নতুন নই, আমি এও জানি না আমার সাথে কি (ধরনের আচরণ) করা হবে এবং তোমাদের সাথেই বা কি (ব্যবহার করা) হবে, আমি শুধু সেইটুকুরই অনুসরণ করি যেটুকু আমার কাছে ওহী করে পাঠানো হয় আর আমি তোমাদের জন্যে সুষ্পষ্ট সতর্ককারী বৈ কিছু নই।’ এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদের খোদাভীতি অর্জন করার তাগিদ দিয়েছেন। যেখানে আমার রাসূল (সা.) আল্লাহর ভয়ে এতই ভীত, সেখানে আমাদের মত নগণ্যদের কি অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়। আমরা তো আশারায়ে মুবাশ্শারা নই। আমাদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে জান্নাত পেতে হবে।
বিপদগামী শিশু-কিশোর-যুবারা যদি শিশু বয়স থেকে আল্লাহর কালামের সংস্পর্শে থাকত, তাদের পিতা-মাতা যদি সৎ পথে থাকার তাগিদ দিত তাহলে হয়তো নয়ন বন্ড সৃষ্টি হত না এদেশে। আমরা যদি কোরআন বুঝে বুঝে অধ্যয়ন করি তবে আমাদের সামনে পরিষ্কার হত সবকিছু আয়নার মতন। কারণ এ কোরআন এসেছে সারা দুনিয়ার মানবজাতির জন্যে-‘এ কোরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্যে পথের দিশা, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন, (হক বাতিলের) পার্থক্যকারী’-সূরা বাকারা আয়াত-১৮৫। কাল কেয়ামতের ময়দানে সব মানবজাতিকে একই রবের সামনে নিয়ে যাওয়া হবে তখন থাকবে না কোন গোত্র, থাকবে না কোন বর্ণ। ‘নিসন্দেহে (মানুষের) জীবন বিধান হিসাবে আল্লাহ তায়ালার কাছে ইসলামই একমাত্র (গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা)’- সূরা ইমরান আয়াত- ১৯। একই সূরার ৮৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বল্ছেন, ‘তারা কি আল্লাহর (দেয়া জীবন) ব্যবস্থার বদলে অন্য কোন বিধানের সন্ধান করছে’? ৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যদি কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন বিধান অনুসন্ধান করে তবে তার কাছ থেকে সেই (উদ্ভাবিত) ব্যবস্থা কখনো গ্রহণ করা হবে না- পরকালে সে চরম ব্যর্থ হবে।’ শেষ বিচারের দিনে দুনিয়ার পরিচিতি কোন কাজে আসবে না। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ, সাংসদ, সচিব, জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি- তারা নিজেদের পরিচয়ে পরিচিত হবেন না সেদিন। সেদিন আল্লাহ্র কাছে সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি হলেন তিনিই, যিনি আল্লাহ্র বিধানগুলো দুনিয়াতে সঠিকভাবে মেনে চলেছেন এবং নিজের পরিবার, সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্রে আল্লাহর অমোঘ বিধান আল্-কোরআনের রাজ কায়েম করার কাজে সদা-সর্বদা লিপ্ত ছিলেন, তাঁরাই হবেন সবচেয়ে মর্যাদাবান, অন্যরা চরম ব্যর্থ হবে।
আজকে নয়ন বন্ডের মতন বহু কিশোর যুবক এখনো অসৎ পথে পরিচালিত হচ্ছে। ফেসবুক, এনড্রয়েড ফোন, সোশ্যাল মিডিয়ায় সারাক্ষণ চোখ থাকে তাদের। এসব দেখে ও শুনে নিজেদের মধ্যে জন্মে অপরাধ প্রবণতা। এখনই তাদের লাগাম টেনে ধরে না রাখলে নিশ্চিত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে তারা পৌঁছতে বাধ্য। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে মাতা-পিতা ও শিক্ষকম-লীদের। বিশেষ করে অপরাজনীতির শিকার হচ্ছে অধিকাংশ কিশোর-যুবক।
তাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপে, টেন্ডারবাজিতে, চাঁদাবাজিতে, দখলবাজিতে। তাইতো আজ দরকার পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব আল্-কোরআনের শিক্ষা, আল্-কোরআনের বয়ান, আল্-কোরআনের তরজমা, আল্-হাদিসের অনুসরণ। আমি মনে করি এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে শান্তি আর সুখের নির্ভেজাল বাতাস। কোরআন হাদিস অনুসরণের মাধ্যমেই সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণ, কুপিয়ে হত্যা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং নেমে আসবে শুন্য লেভেলে। আবারও বইবে ঝির ঝির বাতাস। পাখ-পাখালীর কলতানে মুখরিত হবে এদেশ। ঘরে ঘরে বয়ে যাবে শান্তির ফল্গুধারা।
মাতা-পিতার প্রতি বেড়ে যাবে সন্তানের শ্রদ্ধাবোধ। শিক্ষকের গায়ে আর কোন ছাত্র কেরোসিন ঢালবে না। কোন ছাত্রীর শরীর আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়বে না। ভাই-ভাইয়ে জমি সংক্রান্ত বিরোধ আর থাকবে না, থাকবে না ভাই-ভাইয়ে হানাহানি- খুনোখুনি, স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার মনোমালিন্য। কেয়ামতের সেই কঠিন দিনে আমরা মহান রাব্বুল আ’লামিনকে উপহার দিতে পারব একখ- আল্-কোরআনের দেশ, বাংলাদেশ।

লেখক : সভাপতি, রাউজান ক্লাব, জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট