চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

অঞ্জু ঘোষ ভারতের নাকি বাংলাদেশের নাগরিক ?

‘বেদের মেয়ে জোসনা’কে নিয়ে বিতর্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক

৮ জুন, ২০১৯ | ২:২৭ পূর্বাহ্ণ

নব্বইয়ের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের সাড়া জাগানো অভিনেত্রী ছিলেন অঞ্জু ঘোষ। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এ নায়িকা। তার মোহময়ী হাসির জাদুতে দুই বাংলার দর্শকরা ছিল পাগলপারা।
গত বুধবার ভারতীয় জনতা পার্টিতে (বিজেপি) যোগ দেন অঞ্জু ঘোষ। এরপর থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। সবার মনে এখন প্রশ্ন, অঞ্জু ঘোষ কী ভারতীয়, নাকি বাংলাদেশি।
‘বেদের মেয়ে জোছনা’ খ্যাত এই চিত্রনায়িকার নাগরিকত্ব নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। চলছে আলোচনা-সমালোচনা। প্রশ্ন উঠেছে তার জন্মস্থান নিয়ে।
বিজেপির দাবি, অঞ্জু ভারতীয় নাগরিক। এ জন্য বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে অঞ্জুর পক্ষে একাধিক নথি পেশ করে বিজেপি। কিন্তু সেই নথিতেও দেখা গেছে অসঙ্গতি। বিজেপিতে যোগ দিয়ে অঞ্জু ঘোষও দাবি করেছেন, তিনি ভারতের নাগরিক। ১৯৬৬ সালে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার জন্ম। এর পক্ষে বিজেপিও নথি পেশ করে।
অঞ্জুর দাবি, ভারতীয় নাগরিককে বিয়ে করেছেন তিনি। বিবাহসূত্রে ভারতের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। সংবাদ সংস্থা এএনআই দাবি করেছে, নাগরিকত্ব নিয়ে তাদের প্রশ্ন এড়িয়ে যান অঞ্জু ঘোষ।
অঞ্জুর প্রকৃত নাম অঞ্জলি ঘোষ। ১৯৫৬ সালে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় তার জন্ম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই অঞ্জু এবং তার পরিবার চলে আসেন চট্টগ্রামে। এবং কৃষ্ণকুমারী গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি হন। আর তখন থেকেই শুরু হয় তার নাচ শেখা। এরপর অঞ্জু ঘোষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভোলানাথ অপেরার হয়ে যাত্রায় নৃত্য পরিবেশন শুরু করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের মঞ্চনাটকে জনপ্রিয়তার সঙ্গে অভিনয় করেন। তখন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম হলে নিয়মিত নাটক করতেন তিনি। ‘দুবাইওয়ালা’, ‘রিকশাওয়ালা’, ‘সাতভাই চম্পা’, ‘রূপবান’সহ প্রচুর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মঞ্চায়িত নাটকে অভিনয় করেন ও একশ্রেণির দর্শকের কাছে রীতিমতো ক্রেজে পরিইত হন তিনি। তার সঙ্গে এসব নাটকে জুটি বেঁধে অভিনয় করতেন চট্টগ্রামের জনপ্রিয় অভিনেতা পংকজ বৈদ্য। যিনি পরবর্তীতে সুজন নামে ‘উজান-ভাটি’সহ বেশ ক’টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। চট্টগ্রামের মঞ্চনাটকে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিলো অঞ্জু-পংকজ বৈদ্য জুটির।
১৯৮২ সালে এফ, কবীর চৌধুরী পরিচালিত ‘সওদাগর’ সিনেমার মাধ্যমে তাঁর চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। এই ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে সফল ছিল। তিনি বাংলার নীলো নামে পরিচিত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে তাঁর ক্যারিয়ার বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও তিনি ফিরে আসেন ভালোভাবে। ১৯৮৭ সালে অঞ্জু সর্বাধিক ১৪টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৮৯ সালে তাঁর অভিনীত ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ অবিশ্বাস্য রকমের ব্যবসা করে এবং সৃষ্টি করে নতুন রেকর্ড। চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। এই সিনেমাটি রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসা করেছিল। বাংলাদেশের শহর-বন্দর থেকে একেবারে গ্রামে-গঞ্জে মানুষের মুখে মুখে ছিল বেদের মেয়ে জোসনা। তখন অঞ্জুর ছবি মানেই হিট ছবি। হাতে আসতে থাকে একের পর এক ছবি। তার হিট ছবির মধ্যে ‘সওদাগর’ ‘নরম গরম’ ‘আবে হায়াত’ রাজ সিংহাসন’ চন্দনদ্বীপের রাজকন্যা’ ‘রাজার মেয়ে পারুল’ ‘অর্জন’ ‘দুর্নাম’ ‘কুরবানি’ ‘বেরহম’ ‘আশা নিরাশা’ ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ ‘আশীর্বাদ’ ‘মালা বদল’ অন্যতম।
তিনি ভারত ও বাংলাদেশ দু’ দেশের মোট ৬টি ভাষার ওপর ৩০০টিরও বেশি চলচিত্রে অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রে আগমনের আগে তিনি চট্টগ্রামের মঞ্চে বাণিজ্যিক নাটকের অভিনেত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
১৯৯১ সালে বাংলা চলচ্চিত্রে নতুনের আগমনে শাবনাজদের মতো নায়িকাদের দাপটে তিনি কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান এবং কলকাতার চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে থাকেন। বর্তমানে তিনি ভারতে বিশ্বভারতী অপেরা’য় যাত্রাপালায় অভিনয় করছেন।
উইকিপিডিয়া বলছে, তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। এমনকি বাংলাদেশের বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ তাঁর মাতৃভূমি। সাংবাদিকের ভুল শুধরে দিয়ে তিনি জানান, ‘আমার জন্ম কিন্তু চট্টগ্রামে নয়, ফরিদপুরে। তবে বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে।’ যদিও বিজেপিতে যোগ দিয়ে অঞ্জু ঘোষের দাবি, ১৯৬৬ সালে কলকাতার একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের ‘মধুর ক্যান্টিন’ চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে যোগ দিতে ঢাকায় এসে এফডিসিতে বসে করেছেন স্মৃতিচারণ। অঞ্জু ঘোষ বলেন, ‘আমি যখন চলচ্চিত্রে আসি তখন ক্লাস নাইনে পড়তাম। সেই থেকে অনেক বছর এখানেই কাজ করেছি। এ দেশের প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। কোনো ক্ষোভ নেই। আমি বাংলাদেশকে অনেক ভালোবাসি। এদেশেই আমার জন্ম। আমি সবাইকে খুব মিস করি। এই এফডিসিই ছিল আমাদের ঘরবাড়ি। এটাই ছিল সংসার’।
আশি-নব্বইয়ের দশকে এখনকার চেয়েও অধিক জনপ্রিয় ছিলেন; জনপ্রিয়তার স্রােতের মাঝেও কলকাতায় ডুব দিলেন কেন? বিডিনিউজের সাক্ষাৎকারের প্রশ্নে অঞ্জু ঘোষ বলেন, (হা হা) ডুব দিলাম! কিছুই করিনি এখনো; এখনো কিছুই হয়নি। আমরা দু’দিনের কথা বলে কলকাতায় গিয়েছিলাম। মা খুব অসুস্থ ছিলেন; বাবা মারা গেলেন। ওখানে যাওয়ার পর মায়ের জন্য আটকে গেলাম। মায়ের জন্য যদি একটু সময় দিতে না পারি তাহলে জন্মগ্রহণ করে লাভ কী?
আমার ভাই মায়ের জন্য কানাডা থেকে কলকাতায় এসে থাকছে। ওখানেই বিয়েটা করেছে। সত্যি বলতে, কারো উপর রাগ করে আমি দেশ ছাড়িনি; মায়ের জন্য দেশ ছেড়েছি।

শেয়ার করুন