মুসা (আ:) এর জন্ম মিশরে। তিনি বেড়ে ওঠেন ফেরাউনের ঘরে। ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া বিনতে মুজাহিম তাঁকে মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেন। অর্থাৎ তিনি মুসা(আ:)এর পালকমাতা।ফেরাউন অত্যাচারী ও বদমেজাজি বাদশাহ। অহংকার, দম্ভ ও অহমিকতায় পরিপূর্ণ ছিল তার মসনদ। নিজেকে স্রষ্টা দাবি করেন। পক্ষান্তরে আছিয়া (আ.) ছিলেন এক আল্লাহ বিশ্বাসী মহীয়সী নারী।ছিলেন মানুষের প্রতি দয়ালু ও সহানুভূতিশীল।ধ নী পরিবারের মেয়ে হয়েও কোন অহংকার ছিল না। তিনি মুসা (আ:) এর ধর্মগ্রহণ করেন। অথচ ফেরাউন ছিল মুসা(আ:)এর চরম শত্রু। নিজের স্ত্রীর অন্যধর্ম পালন জানতে পেরে স্ত্রীকে বুঝাতে থাকেন। নিজের বিশাল সাম্রাজ্য ও প্রজাদের কথা বলেন। কিন্তু আছিয়া পাহাড়ের মতো অবিচল, অটল থাকলেন।শত নির্যাতন মেনে নিলেন হাসিমুখে। মুসা তখন যুবক। বাজারে গেলেন কাজে।দেখলেন,দুই ব্যক্তি ঝগড়া করছে। একজন ফেরাউনের অনুসারী কিবতি,অন্যজন ইসরায়েলি। মুসা মীমাংসা করে দিতে চাইলেন। কিন্তু কিবতি তার কথা শুনছিল না। সে বাড়াবাড়ি ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে লাগল। মুসা রাগে কিবতির গালে চড় বসিয়ে দিলেন। লোকটি মারা গেল।
বিদ্যুৎ গতিতে মৃত্যুর খবরছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। ফেরাউনের রাজ্যে তার অনুসারীকে হত্যা!রাজ্য থেকে সিদ্ধান্ত এল,মুসাকেও হত্যা করা হোক। মুসাকে খোঁজা শুরু হলো। মুসার এক শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁকে বললেন,আপনি শহর ছেড়ে দেন। মাদায়েন চলে যান। সেখানে এক বুজুর্গ ও সৎ ব্যক্তি আছেন,তার সংস্রবে থাকতে পারবেন। এই ঘটনায় মুসা (আ:)অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেন।
মুসা (আ:) দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সৌদি আরবের মাদায়েন পৌঁছালেন। পানি পান করতে একটি কূপের কাছে গেলেন। কূপে তখন মানুষের জটলা। শক্তিশালীরা আগেভাগে পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে নিচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে শোয়াইব (আ:) এর দুই মেয়ে
একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন।অপেক্ষা করছেন পুরুষের ভীড় কমার জন্য। মুসা (আ:)তাদের সঙ্গে যেচে কথা বললেন।তাঁদের কূপ থেকে পানি তুলে দিয়ে সাহায্য করলেন।তাঁরা খুশি মনে বাড়ি ফিরলেন।পরে মুসা (আ:) এরও তাঁদের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হলো।
শোয়াইব (আ:) এর দুই মেয়ে চারণভূমিতে ছাগল চরাতেন। বাড়ি ফেরার আগে কূপ থেকে ছাগলগুলোকে পানি খাওয়াতেন। প্রতিদিন তাদের বাড়ি ফিরতে দেরী হতো।ওইদিন বেশ আগে বাড়ি ফিরলেন। বাবা রীতিমতো বিস্মিত। জানলেন এক অপিরিচিত যুবক তাদের পানি তুলতে সাহায্য করেছেন। যুবককে বাড়ি নিয়ে যেতে
এক মেয়েকে পাঠালেন। যুবক রাজি হলেন।বালিকার কাছ থেকে পথ চিনে নিয়ে তাঁকে পেছনে চলতে বললেন। বালিকার প্রতি দৃষ্টি এড়াতে তিনি এ কৌশল নেন। পরে এ ব্যাপার নিয়ে পিতার কাছে প্রশংসা করেছিলেন কন্যা।
যুবক বাড়ি এসে আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন। পানাহার শেষে শোয়াইব (আ:) যে প্রস্তাব দিলেন, তার জন্য যুবক একেবারেই অপ্রস্ত্তুত ছিলেন। কোরআনে রয়েছে, শোয়াইব (আ:) তখন মুসা (আ:)-কে বললেন,আমার এই দুইমেয়ের একজনকে তোমার কাছে বিয়ে দিতে চাই, এ শর্তে যে তোমাকে আমার এখানে ৮বছর চাকরি করতে হবে। আর যদি ১০ বছর পূর্ণ করো, তাহলে তা তোমার ইচছা।মুসা (আ:) জবাবে বললেন, আমার ও আপনার মধ্যে একথা ঠিক হয়ে গেল।।মুসা (আ:),শোয়াইব (আ:)এর দেওয়া শর্ত পূরণ করেছিলেন।বিয়ে করেছিলেন শোয়াইব (আ:) এর বড় মেয়ে
সাফুরাকে। শ্বশুরের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন একটি লাঠি। যেটি তাঁর বহু কাজে লেগেছিল।
আদম (আ:)বেহেস্ত থেকে দুনিয়ায় আসার সময় জিব্রাইল ফেরেস্তা তাঁকে বেহেস্তের আঞ্জির গাছের শাখার একটি লাঠি উপহার দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই লাঠি বংশানুক্রমে প্রত্যেক নবীর হস্তগত হয়ে শোয়াইব (আ:)এর হাতে পৌঁছেছিল।
একদিন শোয়াইব (আ:) লাঠিটি মাটিতে ফেলে মুসা (আ:) কে বললেন, তুমি যদি ওই লাঠি মাটি থেকে তুলে হাতে নিতে পারো, তবে ওটি তোমাকে দান করবো। এটি অত্যন্ত মূল্যবান বস্তু। এটি শুধু নবীদেরই ব্যবহারযোগ্য। মুসা (আ.) তৎক্ষণাৎ বিছমিল্লাহ বলে লাঠিখানা মাটি থেকে উঠিয়ে নিলেন। শোয়াইব (আ:)বললেন, ছাগলের পাল রক্ষণাবেক্ষণকালে এটি তোমার বিশেষ কাজে
লাগবে।তাছাড়া এ লাঠির বরকতে তুমি সকল প্রকার বিপদ থেকে রক্ষা পাবে। সাবধান! তুমি সর্বদা এটি নিজের কাছে রাখিও এবং কখনও এটির অযত্ন করিও না।মুসা (আ:) অত্যন্ত আনন্দের সাথে এই দান গ্রহণ করলেন এবং এটি অতি যত্নের সাথে রক্ষা করতে লাগলেন।
শোয়াইব (আ:),মুসা (আ:) বললেন, ওখানে একটি বিরাট অজগর সাপ আছে ছাগলের পাল নিয়ে ওদিকে যেওনা। অজগর ছাগলের পালের সন্ধান পেলে সব ছাগল খেয়ে ফেলবে। কিছুদিন পর মুসা(আ:) ভুলক্রমে নিষিদ্ধ পাহাড়ের দিকে চলে গেলেন। শোয়াইব
(আ:)এর নিষেধবাণী স্মরণ হওয়ায় ছাগলগুলি তিনি অন্যত্র সরিয়ে নিতে চাইলেও ওই স্থানে অধিক ঘাস থাকায় ছাগলগুলোকে সরিয়ে নিতে পারেন নি। তিনি সেইমাঠেই ছাগলগুলোকে চরিয়ে দিয়ে তার লাঠি মাটিতে রেখে বললেন-হে লাঠি! যদি অজগর আমার ছাগল খেতে আসে, তবে তুমি তাকে মেরে ফেলিও। এই কথা বলে তিনি লাঠি খানা পাশে রেখে গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়লেন।ছাগলগুলি ঘাস খেতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই একটা বড় অজগর বের হয়ে ছাগলের পালের দিকে আসতে উদ্যত হতেই মুসা (আ:) এর লাঠি আর একটা অজগর হয়ে আসল অজগরটিকে মেরে ফেলল।পুনরায় লাঠি হয়ে মুসা (আ:) এর পাশে পড়ে রইল।
মুসা (আ:) ঘুম থেকে জেগে অজগরটিকে মরা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং বাড়ি গিয়ে তা শোয়াইব (আ:)-কে জানালেন। এবার শোয়াইব (আ:)’র আরও দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিল যে মুসা (আ:)ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই নবী হবেন।মুসা(আ:)৪বছর শোয়াইব (আ:)’র বাড়িতে অবস্থানের পর শোয়াইব (আ:) তাঁকে
বললেন- এই বছর ছাগলের পালে যতগুলি নর বাচ্চা হবে,সবই তোমাকে দান করব।আল্লাহর ইচ্ছায় সেই বছর প্রত্যেকটি নর বাচ্চা প্রসব করল। শোয়াইব (আ:)তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুসারে সেই বছরের সবগুলি বাচ্চাই মুসা (আ:)কে দান করলেন।পরের বছর তিনি আবার বললেন-এই বছরে যতগুলি মাদী বাচ্চা হবে, সবই তোমাকে দান করব।আল্লাহর ইচ্ছায় সেই বছর সবগুলি ছাগলই মাদী বাচ্চা প্রসব করল। শোয়াইব (আ:) তাঁর প্রতিশ্রুতি মত সেবারের সবগুলি বাচ্চাও মুসা(আ:) কে দান করলেন। তিনি আবার বললেন, এই বছর পালে যতগুলি কালো রংয়ের বাচ্চা হবে, সবই তোমাকে দান করব। আল্লাহর ইচ্ছায় সে বছর সবগুলি বাচ্চাই কালো রংয়ের হল এবং সবই মুসা (আ:) পেলেন।
এভাবে ৩ বছরে মুসা (আ:) এর নিজস্ব একটি বিরাট ছাগলের পাল হলো। শোয়াইব (আ:) এর এসব প্রতিশ্রুতির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মুসা(আ:)কে পরীক্ষা করা। এই পরীক্ষার পরে তিনি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হলেন,মুসা(আ:)ভবিষ্যতে একজন নবী হবেন। ৮ম বছরে তিনি তাঁর কন্যা সফুরাকে মুসা (আ:) এর সাথে বিয়ে দেন। মুসা (আ:)আসার আগে তিনি পিতার সংসারে ছোট বোনকে নিয়ে জীবিকার তাগিদে ছাগল লালন-পালনের মতো কষ্টকর কাজ করতেন।বিয়ের পরও মুসা (আ:) সেখানে ছিলেন। কিছুদিন পর মুসা (আ:) স্ত্রী সফুরাকে নিয়ে আবার মিশর রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে তাঁকে আল্লাহ নবুয়ত ও রেসালত দান করেন।#
লেখক: ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম
পূর্বকোণ/এএইচ