চট্টগ্রাম বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

আশুরার রোজার ফজিলত ও কারবালার শিক্ষা

মুহাম্মাদ মোরশেদ আলম

১৭ জুলাই, ২০২৪ | ১২:৫২ পূর্বাহ্ণ

আগামী ১০ই মুহাররম (১৭ জুলাই) বাংলাদেশে ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যে ঐতিহাসিক দিবস পবিত্র আশুরা পালিত হবে। আশারা থেকে আশুরা শব্দের উৎপত্তি। এটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে দশ। আরবি সনের প্রথম মাস মুহাররমের ১০ তারিখকে পবিত্র আশুরা বলা হয়। ইসলামের ইতিহাসে এই দিনে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা রয়েছে। এর একটি হলো যালিম শাসক ফিরাউনের হাত থেকে হযরত মুসা আ. এর মুক্তিলাভ এবং অপরটি কারবালার প্রান্তরে নিষ্ঠুর ইয়াজিদি বাহিনী কর্তৃক হযরত ইমাম হুসাইন রা. এর মর্মান্তিক শাহাদাত বরণ।
দলবলসহ নবী সা. দৌহিত্রের আত্মত্যাগের ঘটনা এ দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
পৃথিবীতে অত্যাচারী ও খোদাদ্রোহী শাসকদের একজন ছিল ফিরাউন। অত্যাচারের দৃষ্টান্ত টানতে গেলেই মানুষের মুখে চলে আসে ফেরাউনের নাম। ফেরাউন শুধু অত্যাচারী শাসকই ছিল না, সে নিজেকে খোদা দাবি করতো, আল্লাহর পরিবর্তে মানুষকে তার ইবাদত ও পূজা করতে বলতো। পবিত্র কোরআনের ২৭ টি সুরায় সর্বমোট ৭৪ বার ফেরাউনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং খোদাদ্রোহী এই অত্যাচারীর করুণ পরিণতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। হযরত মুসা আ. ও তাঁর অনুসারীদের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে লোহিত সাগরে ফিরাউন ও তার সৈন্য বাহিনীর সলিল সমাধি হয়। দিনটি ছিল ১০ মুহাররম।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ফিরাউন ও তার বাহিনী জমিনে অন্যায় অহমিকা প্রদর্শন করেছিল। তারা মনে করেছিল তাদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না। সুতরাং আমি তাকে ও তার সৈন্যদেরকে পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম। এবার দেখ, জালিমদের পরিণতি কী হয়ে থাকে! (সূরা : কাসাস ২৮ : ৩৯-৪০)।
মহান রব্বুল আলামিন হিজরি বর্ষের বার মাসের মধ্যে যে চারটি মাসকে বিশেষ মর্যাদায় মহিমান্বিত করেছেন তার মধ্যে মুহাররম অন্যতম। আরবি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ‘মুহাররমুল হারাম’। এখানে হারাম শব্দের অর্থ সম্মানিত। পবিত্র কুরআনুল করিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যেদিন আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর বিধান মতে বারটি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটাই সহজ-সরল দ্বীন (-এর দাবি) অতএব তোমরা এ দিনগুলোতে নিজের উপর জুলুম করো না।’ সূরা তাওবা (৯ : ৩৬)। এ চার মাসের কথা হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে। নবী কারিম সা. বলেন ‘সময়ের হিসাব যথাস্থানে ফিরে এসেছে, আসমান-যমীনের সৃষ্টির সময় যেমন ছিল। (কারণ, জাহেলী যুগে আরবরা নিজেদের স্বার্থ ও মর্জিমতো মাস-বছরের হিসাব কম-বেশি ও আগপিছ করে রেখেছিল।) বার মাসে এক বছর । এর মধ্য থেকে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিক- যিলকদ, যিলহজ্ব ও মুহাররম। আরেকটি হল রজব, যা জুমাদাল আখিরাহ ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস।’-(সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৬২)।
তাই অন্য মাসগুলোর চেয়ে ইসলামে এই চারটি মাসের গুরুত্ব তুলনামূলক বেশি। হাদিসে পবিত্র মুহাররম মাসের মর্যাদা বর্ণনা করে আল্লাহর রাসুল সা. এটিকে ‘শাহরুল্লাহ’ তথা আল্লাহর মাস আখ্যা দিয়েছেন। মুহাররমের এই মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই তিনি বলেছেন, ‘রমজানের পর সব মাসের রোজার চেয়ে মুহাররমুল হারামের রোজা বেশি ফজিলতপূর্ণ’ (সহি মুসলিম)। আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে রমজান ও আশুরার দিন যেমন গুরুত্ব দিয়ে রোজা রাখতে দেখেছি, অন্য সময় তা দেখিনি।’ (বুখারি)
হজরত আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, আমি আল্লাহর কাছে আশা রাখি যে- এই দিনের রোজার কল্যাণে তিনি বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। (সহি মুসলিম)
অন্য এক হাদিসে এই মাসে তওবা কবুল হওয়ার কথাও এসেছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রাখো। কারণ এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্য জাতিগুলোর তওবা কবুল করবেন’ (তিরমিজি)। নবী কারিম সা. ইরশাদ করেছেন, রমযানের পর সবচে উত্তম রোজা হল আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা। আর ফরজ নামাযজর পর সবচে উত্তম নামাজ হল রাতের নামাজ (তাহাজ্জুদের নামায)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৩।
ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসুল সা. হিজরত করে মদিনায় এলেন এবং তিনি মদিনার ইহুদিদের আশুরার দিন রোজা রাখতে দেখলেন। তাদের এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলল, এটা সেই দিন, যেদিন আল্লাহ মুসা আ. ও বনি ইসরাঈলকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরাউন ও তার জাতিকে ডুবিয়ে মেরেছেন। তাঁর সম্মানার্থে আমরা রোজা রাখি। তখন রাসুল সা. বলেন, ‘আমরা তোমাদের চেয়েও মুসা আ.-এর বেশি নিকটবর্তী। এরপর তিনি এ দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৪৮) ।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে এ-ও বর্ণিত আছে যে যখন রাসুল (সা.) নিজে আশুরার দিনে রোজা রাখার আমলটি শুরু করলেন এবং সাহাবাদেরও এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করলেন, তখন কয়েকজন সাহাবি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এই দিনটিকে তো ইহুদি ও খ্রিস্টানরা ‘বড়দিন’ জ্ঞান করে পালন করে, তখন রাসুল (সা.) বললেন, ইনশাআল্লাহ আগামী বছর আশুরার দিন এলে আমরা মুহাররমের নবম দিনেও রোজা রাখবো (যাতে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে সাদৃশ্য না হয়)। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, কিন্তু পরের বছর মুহাররম মাস আসার আগেই রাসুলুল্লাহ (সা.) ইন্তেকাল করেন। (সহি মুসলিম)।
অন্য বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো, তবে এ ক্ষেত্রে ইহুদিদের সঙ্গে মিল না হওয়ার জন্য ১০ তারিখের আগের দিন অথবা পরের দিন আরো একটি রোজা রেখে নিয়ো।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২১৫৪)
উপরের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে মুহাদ্দিসগণ লেখেন যে, এজন্য মুহাররমের দশম তারিখের সঙ্গে নবম তারিখেও রোজা রাখা উচিৎ এবং এটি উত্তম। তবে কোনও কারণে যদি নবম দিন রোজা রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে ১০ তারিখের সঙ্গে ১১ তারিখকে মিলিয়ে দুই দিন রোজা রাখতে হবে। যাতে এক্ষেত্রে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সাদৃশ্য না হয়।
হাদিসে আরও এসেছে, হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, জাহিলি যুগে কুরাইশরা আশুরার দিন রোজা রাখত। রাসুলুল্লাহ (সা.)ও হিজরতের আগে আশুরার রোজা রাখতেন। মদিনায় হিজরতের পরও তিনি আশুরার রোজা রেখেছেন এবং এই রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন। এরপর রমজানের রোজা ফরজ করা হলে আশুরার রোজা নফলে পরিণত হয়। এরপর যে চাইত সে ওই সওম পালন করত আর যে চাইত তা পালন করত না। (বুখারি, হাদিস : ৪৫০৪)।
তাই মহররম মাসে আশুরার দুটিসহ বেশি বেশি নফল রোজা পালন, ইস্তেগফারসহ নিজকে নফল ইবাদতে নিয়োজিত রাখা মুসলমানদের কর্তব্য।
অপরদিকে, কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনা আমরা সবাই জানি।
১০ ই মহররম ৬১ হিজরি। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের একটি দিন। ইরাকের বাগদাদ থেকে একশ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত কারবালা নামক স্থানে ঘটেছিলো ইতিহাসের জঘন্যতম ও হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ড । এদিন ইরাকের কুফা নগরের অদূরে ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) বিশ্বাসঘাতক অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ ও পরিবেষ্টিত হয়ে পরিবার-পরিজন এবং ৭২ জন সঙ্গীসহ নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন। অসম এ যুদ্ধে অন্যায়, অবিচার, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের জন্য রণাঙ্গনে অকুতোভয় লড়াই করে শাহাদতবরণ করেছিলেন; কিন্তু তিনি অসত্য, অধর্ম ও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বাজি রেখে সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তার এ বিশাল আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ইমাম হুসাইন রা. এর সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ইসলামের জন্য তার আত্মত্যাগ যুগের পর যুগ মুসলিম উম্মাহ্ শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে স্মরণ করবে।
হযরত হুসাইন রা.-এর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে আশুরা নিয়ে বেশ বাড়াবাড়ি রয়েছে। আছে অনেক কুসংস্কার। অন্যতম একটি হলো : মাতম-মর্সিয়া গাওয়া। মর্সিয়া মানে নবী দৌহিত্রের শোক প্রকাশে (হায় হুসাইন, হায় হুসাইন বলে) নিজের শরীরে আঘাত করা ও জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা। ইসলামে এটা নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআনের আয়াতে কারীমায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজের উপর নিপিড়ন করতে, নিজের উপর জুলুম করতে নিষেধ করেছেন। নবী করিম (সা.) এ ব্যাপারে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি (শোকে-দুঃখে) চেহারায় চপেটাঘাত করে, জামার বুক ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহিলি যুগের মতো হা-হুতাশ করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (বুখারি, হাদিস : ১২৯৭)।
সুতরাং আশুরার এ মহিমান্বিত দিনে শুধু শোক বা মাতম নয়, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে প্রতিবাদের সংগ্রামী চেতনা নিয়ে হোক চির সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন লড়াই, প্রয়োজনে আত্মত্যাগ- এটাই মহররমের অন্তর্নিহিত শিক্ষা। তাইতো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘মোহররম’ কবিতায় লিখেছেন,
‘ফিরে, এলো আজ সেই মোহররম মাহিনা,
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না!’

মুহাম্মদ মোরশেদ আলম, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট