চট্টগ্রাম বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

শাওয়াল মাসের ফজিলত ও বিশেষ আমলসমূহ

ফখরুল ইসলাম নোমানী

১৯ এপ্রিল, ২০২৪ | ১:০১ অপরাহ্ণ

রমজানের রোজা তাকওয়া অর্জনে সহায়তা করে। শাওয়াল মাসের আমল তাকওয়াকে শাণিত করে। রমজানে পূর্ণ মাস রোজা পালন করা ফরজ আর তার পরের মাস, অর্থাৎ শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখা সুন্নত। আল্লাহতাআলা কোরআন মাজিদে বলেন যখন তুমি (ফরজ দায়িত্ব পালন থেকে) অবসর হবে তখন (নফল ইবাদতের মাধ্যমে) তোমার রবের প্রতি মনোনিবেশ করো (সুরা-৯৪ ইনশিরাহ, আয়াত : ৮)।

 

বরকতময় রমজান মাসের পর আসে শাওয়ালুল মুআজ্জম বা মহিমাময় শাওয়াল মাস। রমজানের বরকত লাভের জন্য ত্যাগ, কষ্ট, ক্লেশ ও দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদের খুশি নিয়ে পশ্চিম আকাশে উদিত হয় পবিত্র শাওয়ালের নতুন চাঁদ। মাসটির প্রথম দিনেই পালিত হয় মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। শাওয়াল হলো আরবি চান্দ্র বছরের দশম মাস। এটি হজের তিন মাসের (শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ) প্রথম মাস ; এই মাসের প্রথম তারিখে ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ।

 

পয়লা শাওয়ালে সদকাতুল ফিতর বা ফিতরা আদায় করা এবং ঈদের নামাজ পড়া ওয়াজিব। এই মাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে হজের, এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে ঈদের, এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে রোজা ও রমজানের এবং এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে সদকা ও জাকাতের। তাই এই মাস আমল ও ইবাদতের জন্য অত্যন্ত উর্বর ও উপযোগী। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত: শাওয়াল মাসে বিয়ে-শাদি সুন্নত, যেরূপ শুক্রবারেও জামে মসজিদে ও বড় মজলিশে আক্দ অনুষ্ঠিত হওয়া সুন্নত। কারণ মা আয়েশার বিয়ে শাওয়াল মাসের শুক্রবারে মসজিদে নববিতেই হয়েছিল।

 

পবিত্র শাওয়াল মাসে অনেক আমল রয়েছে এসব আমলের ফজীলতও অনেক বেশী। এ মাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল হচ্ছে শাওয়ালের ‘ছয় রোজা’। রমজানের পরের মাস শাওয়াল। রমজানে পূর্ণ মাস রোজা পালন করা ফরজ, শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখা সুন্নত। শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যারা রমজানে রোজা পালন করবে এবং শাওয়ালে আরও ছয়টি রোজা রাখবে তারা যেন সারা বছরই রোজা পালন করল।

 

সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- রমজানের রোজা ১০ মাসের রোজার সমতুল্য আর (শাওয়ালের) ছয় রোজা দুই মাসের রোজার সমান। সুতরাং এ হলো এক বছরের রোজা। ছয় রোজা শাওয়াল মাসের বিশেষ সুন্নত। শাওয়ালের ছয়টি সুন্নত রোজা রমজানের কাজা রোজা আদায়ের আগেও রাখা যাবে। যেমন : হজরত আয়েশা (রা.) আমল করতেন। তবে সম্ভব হলে আগে ফরজ রোজার কাজা আদায় করাই উত্তম।

 

মাসের যে কোনো সময় শাওয়ালের ছয়টি সুন্নত রোজা আদায় করা যায়। ধারাবাহিকভাবে বা মাঝেমধ্যে বিরতি দিয়েও আদায় করা যায়। উল্লেখ্য, রমজান মাসে ফরজ রোজা ছাড়া অন্যান্য সব রোজার নিয়ত সাহ্রির সময়ের মধ্যেই করতে হবে। ঘুমানোর আগে বা তারও আগে যদি এই দিনের রোজা রাখার পূর্ণ ইচ্ছা বা দৃঢ় সংকল্প থাকে তাহলে নতুন নিয়ত না হলেও চলবে ; এমতাবস্থায় সাহ্রি না খেতে পারলেও রোজা শুদ্ধ হবে।

 

পবিত্র শাওয়াল মাসে কাজা রোজা আদায় করলে এবং এর সঙ্গে নফলের নিয়ত করলে ফরজ আদায়ের পাশাপাশি নফল রোজা (একের দ্বারা উভয়) পালন হবে না। কারণ একদিকে এটি যুক্তিযুক্ত নয় অন্যদিকে বোধগম্যও নয়। সর্বেপরি এটি নবী করিম (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামের আমলও নয়। চান্দ্র মাস হিসেবে ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে এক বছর হয়। প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কমপক্ষে ১০ গুণ করে দিয়ে থাকেন। এই হিসাবে রমজান মাসে এক মাসের (৩০ দিনের) রোজা ১০ গুণ হয়ে ৩০০ দিনের সমান হয়। অবশিষ্ট ৫৪ বা ৫৫ দিনের জন্য আরও ছয়টি পূর্ণ রোজার প্রয়োজন হয় (যেহেতু অর্ধেক বা অর্ধ দিবস রোজা নেই)।

 

তাই রমজানের (৩০) রোজার কাজা থাকলে তা পূরণ করলে তো মাত্র ৩০টিই হলো আর ছয়টি কোথায়? তাই রমজানের ৩০ রোজা পূর্ণ করতে হবে এবং আলাদা ছয়টি সুন্নত নফল রোজাও পালন করতে হবে; তবেই পূর্ণ বছরের রোজা গণ্য হবে। অযৌক্তিক ও দুর্বোধ্য কৌশল অবলম্বন করা নিজেকে ঠকানো বা আত্মপ্রবঞ্চনার নামান্তর বই কিছুই নয়। নবীজি (সা.) যে হিসাব করে এই ছয়টি নফল (অতিরিক্ত) রোজা সুন্নত করলেন সে সূত্রকে উপেক্ষা করে নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করা প্রকৃতপক্ষে অসুবিধা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

পবিত্র শাওয়াল মাস ইবাদতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। নফল রোজা, নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরিফ, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-কালাম, দান-সদকাহ খয়রাত, ওমরাহ হজ, ছয় রোজা রাখা ইত্যাদির মাধ্যমে এই মাসকে সার্থক ও সাফল্যময় করা যায়। সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত শাওয়াল মাসজুড়ে নিজেদের ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত রাখা।

 

আমল: পবিত্র শাওয়াল মাসের বিশেষ আমল সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো-ছয়টি সুন্নত রোজা, মাস জুড়ে প্রিয় নবি (সা.) এর নিয়মিত আমল-প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা পালন করা, আইয়ামে বিজের রোজা অর্থাৎ চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ নফল রোজা পালন করা। আম্মাজান উম্মে সালামা (রা.) বর্ণনা করেছেন প্রিয় নবীজি (সা.) তিনটি আমল জীবনে কখনো ছাড়েননি: এক. তাহাজ্জতের নামাজ, দুই. আইয়ামে বিদের রোজা, তিন. রমজানের শেষ দশ দিনের ইতিকাফ। প্রতিটি নেক কাজেই রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। আল্লাহ বলেন কেউ কোনো সৎকাজ করলে সে তার ১০ গুণ সওয়াব পাবে। (সুরা আনআম, আয়াত : ১৬০)

 

মহানবী (সা.) বলেন আমাদের মহান রব এরশাদ করেন রোজা হলো ঢালস্বরূপ। বান্দা এর মাধ্যমে নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে। রোজা আমার জন্যই; আমিই এর পুরস্কার দেব। তাই নামাজ, নফল রোজা, তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদত রমজান ছাড়া বাকি ১১ মাসেও বজায় রাখা জরুরি। ইসলামের ইতিহাসের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছে। যেমন শাওয়াল মাসে হজরত লুত (আ.) এর কওম ধ্বংস হয়েছিল, হজরত নূহ (আ.) এর কওম পানিতে ডুবেছিল, হজরত হুদ (আ.) এর কওম বায়ুতে ধ্বংস হয়েছিল, হজরত সালেহ (আ.) এর কওমের শাস্তি অবতীর্ণ হয়েছিল। অথচ হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতের জন্য শাওয়াল মাসকে নেয়ামতের মাস হিসেবে দান করা হয়েছে।

 

রমজানের রোজার অভ্যাস অব্যাহত থাকা অবস্থায় বেশি বেশি নফল রোজা রাখা যায়। বিশেষত, প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবারের সুন্নত রোজা, যা মক্কা মুআজ্জমায় ও মদিনা মুনাওয়ারায় অদ্যাবধি অতীব গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয় এবং অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে ও স্থানীয় পর্যায়ে ইফতারিরও আয়োজন করা হয়ে থাকে।

 

পরিশেষে: আল্লাহতাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তা! তুমি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ-নবির উম্মত হবার কল্যাণে আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে তোমার রহমতের বারিধারায় আমাদেরকে সিক্ত করুন। ফজিলতময় ও বরকতপূর্ণ শাওয়াল মাসে বেশি করে নেক আমল করার তাওফিকে রাফিক এনায়েত করুন ও সকলকে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তৌফিক দিন। সকলেই পড়ি-আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম।

 

আল্লাহ আমাদেরকে অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগি, তওবা-ইস্তেগফার, ছয়টি রোজা রাখা ও অতীতের সব গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুমহান আদর্শ অনুসরণে নিজেদের জীবন-পরিচালনার দৃঢ় প্রত্যয় ও শপথ গ্রহণ করা উচিত। আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে পবিত্র শাওয়াল মাসের বরকত লাভে আমল-ইবাদতে নিয়োজিত থাকার তাওফিক দান করুন। সকলের মাহে রমজানের ফরজ রোজা কবুল করুন ও শাওয়ালের ৬টি রোজা থাকার তাওফিক প্রদান করুন আমিন।

লেখক: ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি চিন্তক।

পূর্বকোণ/এসএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট