চট্টগ্রাম সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

মানবতার মুক্তির সনদ বিদায় হজের ভাষণ

কোরআন ও হাদিস মোতাবেক ইবাদতে পথভ্রষ্ট হবে না কেউ

১৪ জুলাই, ২০২৩ | ১:৫১ অপরাহ্ণ

জীবনে একবার হজ পালন করেছিলেন মুহাম্মদ (সা.)। দশম হিজরিতে হজ পালনকালে ৯ জিলহজ আরাফার ময়দানে প্রায় সোয়া লাখ সাহাবির সামনে তিনি ১০ মিনিটের সংক্ষিপ্ত একটি ভাষণ দেন। সেখানে তিনি উম্মতকে গুরুত্বপূর্ণ ১০টি বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেন। ইতিহাসে এ ভাষণ ‘বিদায় হজের ভাষণ’ নামে পরিচিত। ভাষণে তিনি মানুষের সম্পূর্ণ জীবনবিধান তুলে ধরেন ও উম্মতের কাছ থেকে এ মর্মে সাক্ষ্য নেন যে, তিনি তাদের নিকট আল্লাহর দ্বীন পৌঁছে দিয়েছেন।

 

বিদায় হজের ভাষণ কেয়ামত পর্যন্ত স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ ভাষণ মানবতার মুক্তির সনদ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বিদায় হজের তিনমাস পর ১২ রবিউল আউয়াল মুহাম্মদ (সা.) ইন্তেকাল করেন।

 

বিদায় হজের ভাষণে সর্বপ্রথম কেয়ামত পর্যন্ত রক্তপাত হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। তবে কেউ নিজের জান-মাল হেফাজত করতে গিয়ে মারা গেলে শাহাদাতের মর্যাদা পাবেন। আল্লাহ পাক বান্দার হকের মাঝে সর্বপ্রথম খুনের বিচার করবেন আর তার হকের মাঝে করবেন নামাজের হিসাব।

 

এ ভাষণে পর্যায়ক্রমে আমানত, সুদ, জুলুম, নারীদের হক, মানুষের কেয়ামত পর্যন্ত হেদায়াতের মাপকাঠি কোরআন ও হাদিস, মুসলমান মুসলমানের ভাই, কোরাইশ সম্প্রদায়কে সতর্ক করা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়। পরিশেষে নবী তার রেসালতের দায়িত্ব পালন সম্পর্কে স্বীকারোক্তি আদায় করে বিদায় হজের ভাষণ শেষ করেন।

 

বিদায় হজের ভাষণ:

“হে মানবমণ্ডলী! তোমরা হৃদয়ের কর্ণে ও মনোযোগ সহকারে আমার বক্তব্য শ্রবণ কর। আমি জানি না আগামী বছর এ সময়ে, এ স্থানে, এ নগরীতে তোমাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হবে কি না।

 

হে মানব সকল! সাবধান! সকল প্রকার জাহেলিয়াতকে আমার দু’পায়ের নিচে পিষ্ট করে যাচ্ছি। নিরাপরাধ মানুষের রক্তপাত চিরতরে হারাম ঘোষিত হল। প্রথমে আমি আমার বংশের পক্ষ থেকে রাবিয়া বিন হারেস বিন আবদুল মোত্তালিবের রক্তের দাবি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সে বনি লাইস গোত্রে দুধ পান করেছে, হুজাইল তাকে হত্যা করেছে।

 

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে ‘সুদ’কে চিরদিনের জন্য হারাম ঘোষণা করা হলো। আমি আজ আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিবের যাবতীয় সুদের দাবি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।

 

হে লোক সকল! বল, আজ কোন দিন? (সকলে বলল, “আজ মহান আরাফার দিন, আজ হজের দিন।”) সাবধান! তোমাদের একের জন্য অপরের রক্ত, তার ধন-সম্পদ, তার মান-সম্মান আজকের দিনের মত, এ হারাম মাসের মত, এ সম্মানিত নগরীর মত পবিত্র আমানত।

 

সাবধান! মানুষের আমানত প্রকৃত মালিকের নিকট পৌঁছে দেবে।

 

হে মানব সকল! নিশ্চয়ই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ একজন, তোমাদের সকলের পিতা হজরত আদম (আ.)। আরবের উপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদার উপর কালোর আর কালোর উপর সাদার কোন মর্যাদা নেই। ‘তাকওয়াই’ শুধু পার্থক্য নির্ণয় করবে।

 

হে লোক সকল! পুরুষদেরকে নারী জাতির উপর নেতৃত্বের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তবে নারীদের বিষয়ে তোমরা আল্লাহ তাআলাকে ভয় কর। নারীদের উপর যেমন পুরুষদের অধিকার রয়েছে, তেমনি পুরুষদের উপরও রয়েছে নারীদের অধিকার। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর জামিনে গ্রহণ করেছ। তাদের উপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে তারা স্বামীগৃহে ও তার সতীত্বে অন্য কাউকে শরিক করবে না। যদি কোন নারী এ ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করে, তবে স্বামীদেরকে এ ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে যে, তারা স্ত্রীদের থেকে বিছানা আলাদা করবে ও দৈহিক শাস্তি দেবে, তবে তাদের চেহারায় আঘাত করবে না। আর নারীগণ স্বামী থেকে উত্তম ভরণ পোষণের অধিকার লাভ করবে। তোমরা তাদেরকে উপদেশ দেবে ও তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করবে।

 

হে উপস্থিতি! মুমিনেরা পরস্পর ভাই, আর তারা সকলে মিলে এক অখণ্ড মুসলিম ভ্রাতৃসমাজ। এক ভাইয়ের ধন-সম্পদ তার অনুমতি ব্যাতিরেকে ভক্ষণ করবে না। তোমরা একে অপরের উপর জুলুম করবে না।

 

হে মানুষেরা! শয়তান আজ নিরাশ হয়ে পড়েছে। বড় বড় বিষয়ে সে তোমাদের পথভ্রষ্ট করতে সমর্থ হবে না, তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে তোমরা সর্তক থাকবে ও তার অনুসারী হবে না। তোমরা আল্লাহর বন্দেগি করবে, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে, জাকাত আদায় করবে ও তোমাদের নেতার আদেশ মেনে চলবে। তবেই তোমরা জান্নাত লাভ করবে।

 

সাবধান! তোমাদের গোলাম ও অধীনস্থদের বিষয়ে আল্লাহ তাআলাকে ভয় কর। তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরবে তাদেরকেও সেভাবে পরতে দেবে।

 

হে লোক সকল! আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহ তাআলার পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি? (লোকেরা বলল, “হ্যাঁ”) আমার বিষয়ে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে, সেদিন তোমরা কী সাক্ষ্য দেবে? (সকলে একবাক্যে বললেন, “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি আমাদের নিকট রিসালাতের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন, উম্মতকে সকল বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন, সমস্ত গোমরাহির আবরণ ছিন্ন করে দিয়েছেন এবং ওহির আমানত পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন।”)

 

(অতঃপর আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজ শাহাদাত অঙ্গুলি আকাশের দিকে তুলে তিনবার বললেন) হে আল্লাহ তাআলা, আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি স্বাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন।

 

হে মানুষেরা! আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সম্পদের মিরাস নির্দিষ্টভাবে বণ্টন করে দিয়েছেন। তার থেকে কম বেশি করবে না। সাবধান! সম্পদের তিন ভাগের এক অংশের চেয়ে অতিরিক্ত কোন অসিয়ত বৈধ নয়।

 

সন্তান যার বিছানায় জন্মগ্রহণ করবে, সে তারই হবে। ব্যাভিচারের শাস্তি হচ্ছে প্রস্তরাঘাত। (অর্থাৎ, সন্তানের জন্য শর্ত হলো তা বিবাহিত দম্পতির হতে হবে। ব্যাভিচারীর সন্তানের অধিকার নেই।) যে সন্তান আপন পিতা ব্যাতীত অন্যকে পিতা ও যে দাস নিজের মালিক ব্যাতীত অন্য কাউকে মালিক বলে স্বীকার করে, তাদের উপর আল্লাহ তাআলা, ফেরেশতাকুল ও সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ এবং তার কোন ফরজ ও নফল ইবাদত কবুল হবে না।

 

হে কোরাইশ সম্প্রদায়ের লোকেরা! তোমরা দুনিয়ার মানুষের বোঝা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে যেন কিয়ামতে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ না কর। কেননা আমি আল্লাহর আজাবের মোকাবেলায় তোমাদের কোন উপকার করতে পারবো না। তোমাদের দেখেই লোকেরা আমল করে থাকবে। মনে রেখো, সকলকে একদিন আল্লাহ তাআলার নিকট হাজির হতে হবে। সেদিন তিনি প্রতিটি কর্মের হিসাব গ্রহণ করবেন। তোমরা আমার পরে গোমরাহিতে লিপ্ত হবে না, পরস্পর হানাহানিতে মেতে উঠবে না।

 

আমি সর্বশেষ নবী, আমার পরে আর কোন নবী আসবে না। আমার সাথে ওহির পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে।

 

হে মানুষেরা! আমি নিঃসন্দেহে একজন মানুষ। আমাকেও আল্লাহ তাআলার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে। আমি তোমাদের জন্য দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এ দুটি বস্তু আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হবে না। একটি আল্লাহর কিতাব ও অপরটি রাসুলের সুন্নাহ।

 

হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আমির বা নেতার আনুগত্য করো ও তার কথা শ্রবণ করো যদিও সে হয় হাবশি ক্রীতদাস। যতদিন পর্যন্ত সে আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করেন, ততদিন অবশ্যই তার কথা শুনবে, তার নির্দেশ মানবে ও তার প্রতি আনুগত্য করবে। আর যখন সে আল্লাহর কিতাবের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করবে, তখন থেকে তার কথাও শুনবে না এবং তার আনুগত্যও করা যাবে না।

 

সাবধান! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকবে। জেনে রেখো, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এই বাড়াবড়ির কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। (এ নির্দেশনাটি হচ্ছে অমুসলিমদের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, কোন বিধর্মীকে বাড়াবাড়ি বা জোরজবস্তি করে ইসলামে দীক্ষা দেয়া যাবে না। তবে একজন মুসলমানকে অবশ্যই পরিপূর্ণ ইসলামি জীন্দেগি অবলম্বন করে জীবনযাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে সুবিধাবাদের কোন সুযোগ নেই)।

 

(আবার বললেন) আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর দ্বীন পৌঁছে দিয়েছি? (সকলে বললেন, “নিশ্চয়ই”।)

 

হে উপস্থিতগণ! অনুপস্থিতদের নিকট আমার এ পয়গাম পৌঁছে দেবে। হয়তো তাদের কেউ কেই এ নসিহতের উপর তোমাদের চেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে আমল করবে। তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। বিদায়!”

 

কোরআন ও হাদিস মোতাবেক ইবাদতে পথভ্রষ্ট হবে না কেউ। তাই আপনার পীর, ইমাম বা খতিব আপনাকে আমল দিলে কোরআন আর সুন্নাহ দিয়ে যাচাই করবেন। যদি কোরআন আর সুন্নাহ মত হয় গ্রহণ করবেন। মাথায় নেবেন। নাহলে সেটা দেয়ালে নিক্ষেপ করবেন। এই আমলের দরকার নেই। কেয়ামত পর্যন্ত এটাই শেষ কথা।

 

ভুল বুঝতে পেরে পরে পীর, ইমাম বা খতিব তওবার মাধ্যমে জান্নাতি হতে পারেন । আপনি তো তা আর জানবেন না। আপনার পীর, ইমাম বা খতিব সাহেব তওবা করেছেন বদ আমলের জন্য।  অথচ আপনি মনে করছেন সওয়াবের কাজ।

 

আল্লাহপাক আমাদের বিদায় হজের ভাষণ মোতাবেক আমল করার তৌফিক দিন। আমিন।

 

লেখক: ব্যুরো চিফ, বাংলাভিশন চট্টগ্রাম

পূর্বকোণ/মাহমুদ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট