লাখ লাখ মুসল্লির অবিরল অশ্রুধারায় ভিজেছে ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দান। তাঁদের ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে আরাফাত ময়দান আবারও প্রকম্পিত হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এ ময়দানে যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পবিত্র হজ পালন করেছেন হজযাত্রীরা। এসময় হাজিদের কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। তাঁরা নিজেদের আত্মশুদ্ধি ও পাপমুক্তির আকুল বাসনার পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনায় মহান আল্লাহর কাছে অঝোরে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। নামাজ আদায় করার পাশাপাশি অন্যান্য ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থেকেছেন। মহান আল্লাহর অশেষ রহমত ও নৈকট্য লাভের আশায় সার্বক্ষণিক জিকির করেছেন। প্রায় সারাক্ষণ তালবিয়া পড়েছেন। আল্লাহতায়ালার আনুগত্য প্রকাশ করছেন।
এর আগে, পবিত্র হজ পালনের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিতে সৌদি আরবে আসা বিশ্বের ২৫ লাখ মুসল্লি হজের দ্বিতীয় রুকন আদায়ের জন্য সোমবার সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হন। সূর্যাস্ত পর্যন্ত এই ময়দানেই অবস্থান করেন তাঁরা।
আরাফাতের দিনকে মনে করা হয় বছরের শ্রেষ্ঠ দিন। এদিন মহান আল্লাহ বান্দাদের পাপ মাফ করে দেন। করোনা মহামারি পেছনে ফেলে এবার হজ আবার আগের রূপে ফিরে এসেছে। বলা হচ্ছে, এবারের হজে সবচেয়ে বেশি মুসল্লি এসেছেন। আরাফাত ময়দানের মসজিদে নামিরা থেকে জোহরের নামাজের আগে মিম্বরে দাঁড়িয়ে আরবি ভাষায় হজের খুতবা পাঠ করা হয়। এবার খুতবা দিয়েছেন শায়খ ড. ইউসুফ বিন মোহাম্মদ। তিনি নামাজেও ইমামতি করেছেন। হজের খুতবা বাংলাসহ প্রায় ১৪টি ভাষায় অনুবাদ করে শুনানো হয়েছে।
শায়খ ইউসুফ বিন মুহাম্মদ বিন সাঈদ হজের খুতবায় বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধভাবে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাদের মাঝে দ্বন্দ ও দল উপদল তৈরি করতে নিষেধ করেছেন। আরাফার ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামিয়ায় হাজিদের উদ্দেশে দেওয়া খুতবায় একথা বলেন তিনি।
এ সময় তিনি বলেন, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি একত্রে বসবাস করার মাঝে শান্তি রেখেছেন এবং পরস্পরের মাঝে দ্বন্দ ও বিচ্ছেদের বিষয়টিকে অপছন্দ করেছেন। এবং আমরা আল্লাহকে ভয় করি, তিনি করুণাময় ও দয়ালু। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ সা. তার রসূল বান্দা, যিনি সহাবস্থান ও সহযোগিতার নির্দেশ দিয়েছেন এবং অন্যের সঙ্গে শত্রুতা করতে নিষেধ করেছেন।
খুতবায় তিনি আরও বলেন, আল্লাহ তাঁর রাসুলের মাধ্যমে মানুষের অন্তরকে একত্রিত করেছেন এবং মানুষের অবস্থা সংশোধন করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তার ঘরে জিয়ারত ও মানুষকে জাকাত প্রাদানের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তার রাসুল (সা.)-কে পাঠিয়েছেন এবং মানবতার সংস্কার করেছেন, তিনি আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ঐক্যের মধ্যেই দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণ রয়েছে, মুসলমানদের একে অপরের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে কোরআন-সুন্নাহ থেকে সমাধান খুঁজে নিতে হবে।
শায়খ ইউসুফ খুতবায় আরও বলেছেন, একজন আরবের কোন বিদেশীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই, একজন শ্বেতাঙ্গের কোন কালোর উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই, হজরত মুহাম্মদ বলেছেন, কারো উপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব থাকলে তা কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে, সদাচরণের ভিত্তিতে।
মুসলমানরা, তাকওয়া অবলম্বন কর, আল্লাহকে ভয় কর এবং সংস্কারের চেষ্টা কর, শিরক করো না এবং পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার কর, আল্লাহ পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের অধিকার সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, তোমাদের সব আমল কিয়ামতের দিন আল্লাহ সামনে উপস্থাপন করা হবে। মুসলমান তোমরা অপকে পাপ কাজে সহযোগিতা করো না, সৎকাজে সহযোগিতা করো, শয়তান মানুষের মধ্যে ফাসাদ সৃষ্টি করে, সব মুসলমান এক দেহের মতো। হজের সমাবেশে থেকে পুরো বিশ্বের মুসলিমদের তিনি ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানান।
আজ বুধবার ফজরের নামাজ আদায়ের পর সূর্যোদয়ের আগে কিছু সময় মুজদালিফায় অবস্থান করবেন হাজিগণ। এরপর তাঁরা যাবেন মিনায়। সেখানে মিনার জামারায় (শয়তানের উদ্দেশে পাথর ছোঁড়ার স্থান) বড় শয়তানের উদ্দেশ্যে প্রতীকী সাতটি পাথর নিক্ষেপ শেষে পশু কোরবানি এবং রাসুলুল্লাহর (সা.) আদর্শ অনুসরণে পুরুষরা মাথা মু-ন করে গোসল করবেন। নারীরা চুলের অগ্রভাগ থেকে প্রায় এক ইঞ্চি পরিমাণ চুল কাটাবেন। এরপর হাজীরা সেলাইবিহীন ইহরাম খুলে ফেলবেন এবং পশু কোরবানি দেবেন। পরে তাঁরা হজের তৃতীয় অর্থাৎ শেষ রুকন আদায়ের জন্য মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে সুবহে সাদিকের পর থেকে কাবা শরীফ তাওয়াফ করবেন।
কাবা শরীফের সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় সাতবার ‘সাঈ’ (দৌড়ানো) করবেন। সেখান থেকে তাঁরা আবার ফিরে যাবেন মিনায়, নিজেদের তাঁবুতে। হজযাত্রীরা ১১ জিলহজ আবার মিনার জামারায় গিয়ে জোহরের নামাজের পর থেকে পর্যায়ক্রমে ছোট, মধ্যম ও বড় শয়তানকে সাতটি করে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করবেন। একইভাবে ১২ জিলহজ আবারও ছোট, মধ্যম ও বড় শয়তানকে ২১টি পাথর নিক্ষেপের পর সন্ধ্যার আগে তাঁরা মিনা ত্যাগ করবেন।
পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে সৌদি আরবের হিজরি বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী ১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত যে কোনো সময়ে কাবা শরীফকে ফরজ তাওয়াফের মধ্য দিয়ে।
পূর্বকোণ/এসি