প্রায় চার হাজার বছর আগে ইরাকের বাবেল শহরে জন্মগ্রহণ করেন ইব্রাহিম (আ)। তখন ইরাকের বাদশাহ ছিলেন নমরুদ। নমরুদের একজন কর্মকর্তা আজরের ঘরে ইব্রাহিম (আ) এর জন্ম। গণকরা নমরুদকে বলেছিল, আপনার এলাকাতে একজন সন্তানের জন্ম হবে, যে সন্তানের হাতে আপনার ক্ষমতা শেষ হবে। তখন নমরুদ সিদ্ধান্ত নিল, যত সন্তান আসবে সবাইকে হত্যা করা হবে। কিন্তু এর ফাঁকেও আল্লাহপাক ইব্রাহিম (আ) কে দুনিয়াতে আসার ব্যবস্থা করেছেন। সুবহানাল্লাহ। ইব্রাহিম (আ) ধাপে ধাপে বড় হলেন। তারমধ্যে জ্ঞান-বুদ্ধি একটু একটু করে আসার পর কুফর, শিরক এর বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করলেন।
সেখানকার লোকরা ছিল মূর্তিপূজারী। তাদের গণকদের প্রতি ছিল অগাধ বিশ্বাস। তারা চন্দ্র- সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি সবকিছুর পূজা করতো। বাল্যকাল থেকেই ইব্রাহিম (আ) এসব নিয়ে তর্ক করতেন। একপর্যায়ে তারকা ডুবে গেলে তিনি তর্ক করলেন যিনি ডুবে যান তিনিতো আমাদের মাবুদ হতে পারেন না।এভাবে ইব্রাহিম (আ) যুক্তি তর্ক করলেন। চন্দ্রকে আমার মাবুদ বলতে পারি। যখন চন্দ্র ডুবে যায় তাকে আমরা মাবুদ বলতে পারি না। এভাবে সূর্যের ব্যাপারেও একই যুক্তি দিলেন। যুক্তির মাধ্যমে নিজের পিতা আজরকে তিনি পরাজিত করেন।
তিনি ছিলেন আদম (আ) এর এগারোতম বংশধর। নমরুদের লোকজন ইব্রাহিম (আ)কে তারা কূফর, শিরক এর দাওয়াত দিত এবং একদিন তাদের মেলায় যাওয়ার আহবান জানায়। তখন তিনি বলেন, আমি অসুস্থ। শিরক এ লিপ্ত হওয়ায় ভয়ে তিনি শারীরিক নয়, মানসিক অসুস্থ ছিলেন। ওরা শারীরিক অসুস্থ মনে করে চলে যায়। ওরা ফিরে যাওয়ার পর ইব্রাহিম (আ) তাদের উপাসনালয়ে গিয়ে কুড়াল দিয়ে সব মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন। বড়মূর্তির কাঁধে কুড়াল রেখে তিনি চলে আসেন। ওরা পরে বুঝতে পারলো এসব মূর্তি ভেঙ্গে ফেলার কাজ আজরের ছেলে ইব্রাহিম’র। মেলায় না গিয়ে এসব কাজ করেছে। ইব্রাহিম (আ)কে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় এ কাজ কে করেছে? তখন তিনি বলেন, তাদের বড়টাই করেছে। তখন তারা বুঝল বড়টার সেই ক্ষমতা নেই। ইব্রাহিম (আ) বললেন, যার নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই সে কিভাবে মাবুদ হতে পারে ? তখন তারা বুঝে গেল এটা ইব্রাহিম এর কাজ।
সিদ্ধান্ত হলো ইব্রাহিমকে মেরে ফেলতে হবে। তখন নমরুদ বিশাল অগ্নিকুন্ড তৈরি করলেন। কিন্তু ইব্রাহিমকে অগ্নিকুণ্ডের কাছে গিয়ে নিক্ষেপ করার মতো অবস্থা নেই। আগুনের কাছে গেলে নিজেরাই পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। তখন চরকা তৈরির সিদ্ধান্ত হলো। চরকার মাথায় ইব্রাহিমকে আটকে ঘুরাতে ঘুরাতে দূর থেকে আগুনে নিক্ষেপ করা যাবে। কিন্তু চরকা আর ঘুরে না। শয়তান বুঝতে পারলো এটা আটকানো হয়েছে। যাতে ইব্রাহিমকে আগুনে নিক্ষেপ করা না যায়। তাই সিদ্ধান্ত হলো কিছু উলঙ্গ নর্তকী সামনে নিয়ে আসার। যখন রহমতের ফেরেশতা চলে যাবে তখন ইব্রাহিমকে আগুনে নিক্ষেপ করা যাবে। এভাবে নগ্ননারীদের সামনে এনে ইব্রাহিমকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হল। পরে সেই মহিলাদের কপালে লাল টিপ দিয়ে সম্মানিত করলো নমরুদ।
ওদিকে আসমানের ফেরেশতারা বলছেন, পৃথিবীর বুকে একমাত্র তৌহিদের বাণী প্রচারকারী ইব্রাহিম যদি মারা যান দ্বীন কে প্রচার করবেন। হযরত জিবরাইল (আ), ইব্রাহিম (আ) এর কাছে এসে বললেন, হে ইব্রাহিম আমার কাছে সাহায্য চাও। কিন্তু ইব্রাহিম (আ) বললেন, আমার সাহায্যের দরকার আছে, কিন্তু তোমার না, আল্লাহপাকের সাহায্য দরকার। জিবরাইল (আ), বললেন, তাহলে তুমি আল্লাহর সাহায্য চাও। তিনি বললেন, আল্লাহপাক আমার অবস্থা জানেন। আল্লাহপাক তখন আগুনকে নির্দেশ দিলেন, “ হে আগুন! ইব্রাহিম এর জন্য তুমি শীতল হয়ে যাও, আরামদায়ক হয়ে যাও”। আগুনের কুন্ডলি ইব্রাহিম (আ) এর জন্য জান্নাতের বাগানে পরিণত হলো। দুনিয়ার পোশাক পুড়ে ছাই হলো। আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতের পোশাক পরালেন। তাঁর খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করলেন। শেষে আল্লাহপাক ইব্রাহিম (আ)কে মুক্ত করলেন। তখন নমরুদ বুঝতে পারলো ইব্রাহিম (আ) এর খোদার ক্ষমতা অনেক বেশি। ৪০দিন পর ইব্রাহিম (আ) কে মুক্তি দিল।
পরে তিনি প্যালেস্টাইনে চলে যান। সাথে নিলেন বিবি সারাহ ও তার ভাতিজা লূত (আ)কে। পথিমধ্যে বিবি হাজেরাকে বিবাহ করলেন। সবাইকে নিয়ে আল আকসায় পৌঁছান এবং সেখানে বসবাস শুরু করেন। সেখানে বিবি হাজেরার সন্তান জন্ম নিলেন ইসমাইল (আ) । ইসমাইল (আ) এর জন্ম হওয়ার পর আল্লাহপাকের নির্দেশ হলো হাজেরা এবং ইসমাইল (আ) কে মক্কায় রেখে আসার। ইব্রাহিম (আ) তাদেরকে মক্কায় রেখে আসলেন। হাজেরাকে বলে আসলেন, আল্লাহপাক তোমাদের এখানে বসবাসের নির্দেশ দিয়েছেন। তখন হাজেরা বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহপাক আমাদের দেখবেন। বিবি হাজেরা, ইসমাইল (আ)কে রেখে পানির জন্য সাফা- মারওয়ার মধ্যে দৌড়া- দৌড়ি করলেন। ৭ বার চক্কর দিয়ে আবার ছেলের কাছে এসে দেখেন আজকের জমজম কূপের জায়গা থেকে পানি বের হচ্ছে। আল্লাহপাক ৭বার চক্কর পছন্দ করায় এটি ওয়াজিব করে দিয়েছেন।
ইসমাইল (আ) এর বয়স যখন ৯বছর হলো। আল্লাহপাক ইব্রাহিম (আ)কে স্বপ্ন দেখালেন। ইব্রাহিম তুমি কোরাবনি কর আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির জন্য। নবীদের স্বপ্ন ওহী হিসেবে গণ্য হয়। তখন তিনি পরপর তিনদিন একশ’ উট কোরাবনি দিলেন। পরে বলা হলো প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ)কে কোরাবনি দিন। সেই স্বপ্ন আসার পর ইব্রাহিম (আ) সেহেরীর মধ্যে রওয়ানা দিলেন। বিবি হাজেরার কাছে পৌঁছে বললেন, আজ আমাদের একটি অনুষ্ঠান আছে, ইসমাইল (আ)কে প্রস্ত্তুত করে দাও। সাথে ছুরি নিলেন ইব্রাহিম (আ)। ইসমাইল (আ)কে সাথে নিয়ে মিনার দিকে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে শয়তান নানাভাবে ধোকা দিতে লাগলেন। ইব্রাহিম (আ) শয়তানকে পরপর তিনবার ৭টি করে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করলেন। এভাবে শয়তানকে তাড়িয়ে দিলেন। এটা ইব্রাহিম (আ) এর স্মৃতি। বর্তমানে সেখানে শয়তান নেই। তারপরও পাথর নিক্ষেপ করা হয় শয়তানকে লাঞ্চনা দেয়ার জন্য।
মিনার মাঠে কোরবানি করার জন্য ইব্রাহিম (আ)কে নির্দেশ দিলেন। তখন ইব্রাহিম (আ), ইসমাইল (আ)কে বললেন, আজ তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি আল্লাহপাকের একটি আদেশ পালন করার জন্য। ইসমাইল (আ) বলেন, বাবা আল্লাহপাক আপানকে যে নির্দেশ দিয়েছেন, সেই নির্দেশ অবশ্যই পালন করবেন। আমি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অর্ন্তভুক্ত হয়ে যাব। কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবো না। তখন ইসমাইল (আ) একটি নসিয়ত করলেন, বাবা আপনি আমাকে যখন কোরাবনি দিবেন, আগে আমার শরীরের অঙ্গগুলো রশি দিয়ে বেঁধে নিন। কারণ আমার নড়াচড়ার কারনে আপনার কাজে সমস্যা হবে। দ্বিতীয় হলো-আপনি আমাকে উপুড় করে কোরাবনি করবেন, কারন চেহারা দেখলে মায়ার কারণে আল্লাহর হুকুম পালনে দেরি হতে পারে। আর তৃতীয়- রক্তমাখা জামা দিয়ে আমার মাকে সালাম জানাবেন।
শেষে তিনি কোরবানির জন্য প্রস্তুত হলেন। ইব্রাহিম (আ) ছেলেকে মাটিতে শুইয়ে চোখ বন্ধ করে ছুরি চালালেন। ফেরেশেতারা দেখছেন রুহে মোহাম্মদি (সা) যদি কোরবানি হয়ে যায় শেষ নবী পৃথিবীতে কিভাবে আসবেন। আল্লাহপাক ইব্রাহিম (আ) কে পরীক্ষা করছেন। বারবার ছুরি চালানোর পরও ইসমাইল (আ) এর একটি পশমও কাটেনি। ইব্রাহিম (আ) হাতের ছুরি নিক্ষেপ করলে পাথর কেটে দু’টুকরা হয়ে যায়। এরইমধ্যে আল্লাহপাক জিবরাইল ফেরেশতার মাধ্যমে আসমান থেকে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দিলেন। জিবরাইল (আ) আসতে দেরি করলেন। আসমান থেকে আসার পথে ডাক দিলেন আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর। সেই কথা শুনে ইসমাইল (আ) বললেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর। ইব্রাহিম (আ) দুম্বা কোরবানি দেখে বললেন, আল্লাহু আকবর ওয়ালিল্লাহি হামদ। ইব্রাহিম (আ) মনে করলেন ইসমাইল (আ)কে কোরবানিতে তিনি সফল। কিন্তু চোখ খুলে দেখলেন ইসমাইল (আ) পাশে। তাঁর জায়গায় কোরবানি হলো দুম্বা ।
পরে আল্লাহপাক ইব্রাহিম (আ) এর উদ্দেশ্যে আয়াত পাঠালেন। হে ইব্রাহিম তুমি অবশ্যই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছ। এমন আল্লাহর অনুগতদের আমি অবশ্যই প্রতিদান দিই। এভাবে আল্লাহপাক ইব্রাহিম (আ)কে পরীক্ষা করেছেন বিভিন্নস্থানে। সব পরীক্ষায় ইব্রাহিম (আ) পাশ করেন। কোরআন শরীফে আল্লাহপাক বলেন, ইব্রাহিম অসংখ্য পরীক্ষায় পাশ করেছ। তাই আমি তোমাকে ধর্মীয় নেতা বানিয়ে দেব। ইব্রাহিম (আ) বললেন, আমি খুশি হয়ে গেলাম। আমাকে ধর্মীয় নেতা বা নবী বানাবেন, কিন্তু আমার সন্তানদেরও ধর্মীয় নেতা বানিয়ে দিন। তারা যেন দ্বীন প্রচার করে সওয়াব অর্জন করতে পারে। আল্লাহপাক উত্তর দিলেন, ইব্রাহিম তোমার সবাইকে আমি ধর্মীয় নেতা বানাব না, কিন্তু যারা মুত্তাকী হবে তাদের আমি ধর্মীয় নেতা বানিয়ে দিব।
তাই এরপর সকল নবী ও রাসূল ইব্রাহিম (আ) এর বংশধর থেকে এসেছেন। ইসমাইল (আ) এর বংশ থেকে একমাত্র এসেছেন শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা)। ইব্রাহিম (আ) এর দ্বিতীয় ছেলে ইসহাক (আ) এর বংশধর থেকে এসেছে বনী ইসরাইলের নবীরা। ইসহাক (আ) এর ছেলে ইয়াকুব (আ) এর অপর নাম ইসরাইল। ইয়াকুব (আ) এর ১২ ছেলে ছিল। তারমধ্যে একজন ইউসুফ (আ)। ইয়াকুব (আ) এর ১২ ছেলের বংশধরকে বলা হয় বনী ইসরাইল। তাদের থেকে ইহুদি এবং খৃষ্টান ধর্ম। এভাবে আল্লাহপাক ইব্রাহিম (আ) এর সেই দোয়া কবুল করেন।
প্রতিবছর আর্থিক ইবাদত হিসেবে আসে কোরবানি। সামর্থ্যবান মুসলিমের উপর কোরবানি ওয়াজিব করা হয়েছে। মাসিক খরচ ও ঋন বাদ দিয়ে ৮২ হাজার নগদ টাকা থাকলে অকেজো সম্পদ থাকলে যা বিক্রি করে কোরবানি করা যায় তাদের উপর কোরবানি ওয়াজিব । আল্লাহপাক আমাদের সকলকে কোরবানি করার তৌফিক দান করুন।
লেখক: ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম।
পূর্বকোণ/জেইউ/পারভেজ