গায়েব হলো অদৃশ্য। মানুষের চোখের সামনে উপস্থিত নয়, এমন জিনিসই গায়েব। গায়েবের বিষয়ে জানেন একমাত্র আল্লাহ। অন্য কেউ গায়েবের বিষয়ে অবগত নন। গায়েব নবী-রাসূলরা জানেন ওহীর মাধ্যমে। নবী-রাসূলরা ওহীর মাধ্যমে ততটুকু জানেন, আল্লাহ যতটুকু তাদের জানান। সরাসরি অদৃশ্য সম্পর্কে আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানে না। এমনকি কোন ফেরেশতাও নয়। আল্লাহ ইচ্ছা অনুযায়ী মাখলুককে অদৃশ্য সম্পর্কে জানান। যেমন জান্নাত-জাহান্নাম সম্পর্কে ফেরেশতাদের জ্ঞান থাকলেও মানুষ এসম্পর্কে কিছু জানত না। আল্লাহ তায়ালা ওহীর মাধ্যমে মানুষকে জানিয়েছেন। আবার কিয়ামত সংগঠিত হওয়ার মুহূর্ত সম্পর্কে কোন সৃষ্টিই অবগত নয়।
আল্লাহর সামনে বর্তমানের মতো ভবিষ্যতও উপস্থিত। অতীততো জানেনই। তাই আল্লাহর কাছে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সব সমান। এখানে কোন পার্থক্য নেই। অর্থাৎ আল্লাহর দৃষ্টিতে সব সমান। আল্লাহর কাছে কোন গায়েব নেই। গায়েব যা আছে সব আমাদের জন্য।
মৌলিক যে বিষয়গুলোর প্রতি ঈমান আনার মাধ্যমে আমরা মুসলমান হিসেবে স্বীকৃত হই, তার সবই কিন্তু গায়েব। আল কুরআনে মুমিন-মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথমটিতেই বলা হয়েছে ‘তারা অদৃশ্য বা গায়েবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে।’ (বাকারা:৩) আল্লাযিনা ইউমিনুনা বিল গাইব। অর্থাৎ যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে। আল্লাহ, ফিরিশতা, পরকাল ইত্যাদি সবইতো না দেখে বিশ্বাস করতে হয়।
আসলে বিশ্বাস বা ঈমানের প্রশ্ন না দেখা বিষয়ের সাথেই সম্পর্কিত। কোনো জিনিস দেখার পর তা বিশ্বাস না করার কোনো সুযোগ নেই। সেটা করলে বরং মানুষ আপনাকে পাগল বলবে। বিশ্বাস সেই জিনিসের প্রতিই করতে হয় যেটি আমি দেখিনি বা আমি জানি না। উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি, কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল আছে, এমন কথাটি যিনি চট্টগ্রাম কখনো আসেননি অথবা টানেলটি কখনো দেখেননি তাকে বলা যায়। এখন তিনি বিশ্বাস করতে পারেন অথবা নাও পারেন। কিন্তু আপনি যদি টানেলটি দেখার পর বলেন যে, আমি বিশ্বাস করি এর কোনো মূল্য নেই অথবা যদি বলেন আমি বিশ্বাস করি না, তাহলে পাগল ছাড়া আর কী বলা যায়!
ঠিক তেমনি আমরা আমাদের রুহ আছে বিশ্বাস করলেও তা অদৃশ্য । শরীরে প্রবহমান রক্তে গ্লুকোজ’র মাত্রা বেড়ে গেছে আপনার ডাক্তার বললেন। আপনি কিন্তু আপনার রক্তের মধ্যে কোনো গ্লুকোজ দেখেননি, এটি পরীক্ষার মাধ্যমে একজন বিশেষজ্ঞই শুধু দেখতে পান। এখন আপনাকে হয় ওই পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ হতে হবে, না হয় এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞের কথার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো ব্যক্তি যদি গোঁ ধরে যে, রক্তে চিনি না দেখা পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করব না; তাহলে এমন ব্যক্তির দুর্ভোগ!
মুমিন, মোত্তাকি তারা যারা গায়েবের প্রতি বিশ্বাস রাখে।মানুষের যুক্তি ও পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরের বিষয় গায়েব। মৃত্যুর পর সবকিছু গায়েবের অর্ন্তভুক্ত। কবর, আযাব, পরকাল, হাশর, জান্নাত, জাহান্নাম, বিচার, হাউজে কাওসার ইত্যাদি। আরও অসংখ্য বিষয় গায়েবের অন্তর্ভুক্ত যা আমরা দেখি না। মুহাম্মদ (সা.) দুনিয়া ও আখেরাত বিষয়ে অনেক গয়েব বর্ণনা করেছেন। আদম (আ.) এর দুনিয়াতে আসা, হাবিল-কাবিলের ঘটনা এগুলো আমাদের কাছে ছিল গায়েব। আমরা ওহীর মাধ্যমে জানতে পেরেছি।গায়েব জানান মাধ্যম ছিল ওহী। ওহী না আসলে আমরা কিছু জানতাম না। ওহী না আসলে আমরা নূহ, ইব্রাহিম, মূসা, ইউসুফ, মরিয়ম, ঈসা (আ.) এর ঘটনা জানতাম না। কোরআন-হাদীসে আসা বিষয় গায়েবের অন্তর্ভুক্ত। এসব ওহী ছাড়া আমাদের জানার কোন উপায় ছিল না।
এভাবে ভবিষ্যতে দুনিয়াতে অসংখ্য ঘটনা ঘটবে তাও গায়েবের অন্তর্ভুক্ত। কিছু গায়েব আমরা কোরআন-সুন্নাহর মাধ্যমে জেনেছি। কিছু গায়েব আছে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। যা ওহীর মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দেননি।সে গুলোর প্রতি আমাদের বিশ্বাস রাখার প্রয়োজন নেই। কোরআন-হাদীসের মাধ্যমে জানা গায়েবের প্রতি বিশ্বাস ঈমানের অংশ। ভবিষ্যতে কেয়ামত পর্যন্ত যেগুলি হবে সেগুলোর প্রতিও বিশ্বাস রাখতে হবে।
রাসূল (সা.) গায়েব জানেন সীমিত। যতটুকু আল্লাহ জানিয়েছেন ততটুকু জানেন। এর বাইরে জানেন না।আমরাও গায়েব ততটুকু জানি রাসূল (সা.) আমাদের যতটুকু জানিয়ে দিয়েছেন। আবার আল্লাহর গায়েবি জ্ঞানের তুলনায় রাসূলের গায়েবি জ্ঞান এক ফোটা পানির সমান নয়। আল্লাহর গায়েবি জ্ঞান অসীম। রাসূলের হলো সীমাবদ্ধ।
একসময় মহানবী মক্কায় মাকামে ইব্রাহিমের পাশে নামাজ পড়ছিলেন। তখন আবু জাহেলসহ ৭ জন নেতা সাফা পর্বতে বসা ছিলেন। যখন তারা দেখলো মুহাম্মদ (সা.) সেজদায় পড়েছেন, তখন বললো, তোমাদের মধ্যে সাহসী কে আছো। সে-তো দীর্ঘ সেজদা করে অনকে দোয়া-দরুদ পড়ে। গতকাল জবাই করা উটের নাড়ি বুড়িটা তার গর্দানের উপর দিয়ে আসবে। তখন একজন গিয়ে উটের নাড়ি বুড়িটা রাসূলের গর্দানের মধ্যে রেখে আসলো।নবী আর সেজদা উঠতে পারছিলেন না।তখন এক ব্যাক্তি গিয়ে পাশে রাসূলের বাড়িতে খবর দেন। ফাতেমা (রা.) পিতার গর্দান থেকে তা সরিয়ে নেন। এরপর মহানবী নামাজ শেষ করে আল্লাহর কাছে বদ দোয়া করেছেন, হে আল্লাহ, যারা তাদের নবীকে কষ্ট দেয় তাদের ধ্বংস অনিবার্য। আবু জাহেলসহ যে ৭ জন এই কাজ করেছে তাদের জন্য ধ্বংস দিবেন। তারা যেন মুসলমানের হাতে নিহত হয়। এভাবে তিনি তিনবার বদ দোয়া করেন। তিনি দোয়া করলেও ৩ বার বদ দোয়া করলেও তিনবার বলতেন।
এতক্ষণ ওরা ৭ জন হাসহাসি করছিল রাসূলের বদদোয়া শুনে চেহারা মলিন হয়ে গেল। কারণ তারা জানে মুহাম্মদ (সা.) কোন দোয়া কিংবা বদদোয়া কথা বৃথা যায় না। তারা বিপদে পড়ার আশংকা করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মসুদ বলেন, বদর যুদ্ধে ওই ৭ জন হাজির ছিলেন। দেখা গেল ৭০ জনের মধ্যে ওই ৭জন নিহত হয়েছেন। সুবহানাল্লাহ। রাসূলের বদ দোয়া বাস্তবায়িত হয়েছে।
এভাবে আবু লাহাবকে রাসূল বদ দোয়া করেছিলেন। আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দিন। তার ছেলেকে একটি বাঘের খোরাক বানিয়ে দিন। তিনি অগ্রিমভাবে বদদোয়া করেছিলেন। তার ছেলেকে আল্লাহ অবশ্যই বাঘের খোরাক বানিয়েছেন। আবু লাহাবের ছেলে যখন সফরে গেলে তখন মুহাম্মদ (সা.) এর কথা মনে পড়লো। ছেলেকে আবু লাহাব বললো, মুহাম্মদ তো তোমার জন্য বদ দোয়া করেছে। তার দোয়া ফলে যায়। তাই তুমি সমস্ত মালামাল একত্র করে তার উপরে শুয়ে থাক।দেখা গেল ঠিকই ঘুমন্ত অবস্থায় বাঘ এসে সবার শরীরের গন্ধ শুকে আবু লাহাবের ছেলেকে ঘাড় মটকে মেরে ফেললো।
আবু লাহাব সম্পর্কে ও রাসূল বদদোয়া করেছেন। কিন্তু সে বদর যুদ্ধ এড়িয়ে যায়।এড়ানোর কারণ মোহাম্মদ(সা.)এর বদদোয়া। ভাবছিল,আমার ছেলে ধ্বংস হয়েছে। আমি গেলে আমারও একই অবস্থা হবে।তাই সে যায়নি। তার পরিবর্তে টাকা দিয়ে কয়েকজন গোলাম যুদ্ধে পাঠায়।বদরযুদ্ধের পরপরই তার মধ্যে চোয়াছে রোগ হয়। তাঁর শরীরে পঁচন ধরে। কেউ তার কাছে যাচ্ছে না। তাদের মধ্যেও সংক্রমন হবে এই ভয়ে।পরিশেষে মৃত্যুর পর মানুষ তাকে দাফন করতে চায়নি।তখন দূরে গর্ত খনন করে লাঠি দিয়ে ঠেলে তাতে লাশ ফেলা হয়।
খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)যার উপাধি ছিল সাইফুল্লাহ। তিনি শত শত যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন কিন্তু তার মৃত্যু হয়েছে স্বাভাবিক অবস্থায় বিছানায়।মৃত্যু যেখানে লেখা সেখানে হবে।মৃত্যু থেকে পালানোর কোন সুযোগ নেই।
রাসূল(সা.)এর কিছু গায়েবি সংবাদ আগে চলে গেছে।বিভিন্ন নবী-রাসূলদের কথা।আরো বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের কথা। যেগুলো আল্লাহপাক রাসূলের মাধ্যমে আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন।রাসূলের জীবদ্দশার আগেই কিছু সংঘটিত হয়েছে।কিছু রাসূলের মৃত্যুর পর হয়েছে। আর কিছু গায়েবি বিষয় আগামীতে ঘটবে। অর্থাৎ কেয়ামতের আগে আগে সংঘটিত হবে।সেগুলো আস্তে আস্তে হবে। এসবের উপর আমাদের ঈমান রাখতে হবে।
ঠিক তেমনি মৃত্যুর পর কবর আযাব। পরকালে আরো যেসব গায়েবি সংবাদ আছে জান্নাত-জাহান্নাম, ফুলসেরাত. হাশর,বিচার দিবস সবগুলো সম্পর্কে আমাদের আকিদা পোষণ করতে হবে।মুনকার-নাকির ফেরেশতা দুই কাঁধে আছে আমাদের জানার বাইরে। জ্বিন দুনিয়ায় আছে বিশ্বাস করতে হবে।আল্লাহপাক কোরআনের আগে ১০৩টি আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন তাতে বিশ্বাস করতে হবে। তবে লাখ লাখ গায়েব বিষয় আছে, যা আমাদের রাসূল বলেন নাই সে সবে আমাদের বিশ্বাস নেই।যেসব আল্লাহ ও রাসূল বলেন নাই সেসব আমাদের বিশ্বাসের বাইরে। গায়েব হলো ওই সমস্ত বিষয় যা ওহী ছাড়া জানা যায় না।ওহী না আসলে আমরা কবরের আজাব সম্পর্কে জানতাম না। নবী-রাসূলদের কাহিনী জানতাম না।মুমিন-মোত্তাকী যারা গায়েব বা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে। আল্লাহপাক রাসূল (সা.) এর মাধ্যমে যেসব গায়েব বিষয় বলেছেন, সে সবের প্রতি বিশ্বাস রাখার তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক: ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম
পূর্বকোণ/এএইচ