চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

পবিত্র ঈদুল আজহা কাল

রায়হান আজাদ

২৮ জুন, ২০২৩ | ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ

আগামীকাল পবিত্র ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। ইসলামী দিবসসমূহের মধ্যে এ দিনের তাৎপর্য অপরিসীম। আরবি ‘কোরবান’ শব্দ থেকে কোরবানি শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ ত্যাগের মাধ্যমে নৈকট্য লাভ করা। পশু কোরবানির মাধ্যমে এ দিনে বান্দা আত্মত্যাগ স্বীকার করত আল্লাহর নৈকট্য লাভে ব্রতী হয়। ফলে মুসলিম উম্মাহর ঘরে ঘরে দ্বীনি আমেজে প্রাণ স্পন্দন জেগে উঠে। ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব সৌহার্দ্য ও সহানুভূতির গভীর বন্ধনে শান্তির সুবাতাস নেমে আসে।

 

ঈদের জমায়েতে পারস্পরিক সালাম, কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়ে অকৃত্রিম আত্মীয়তা জমে উঠে। সমাজের দীনহীন অনাথ এতিম ও হতাশ শ্রেণি একদিনের জন্য হলেও নিজেদের অধিকার ফিরে পায়। অমলিন হৃদয়ে হাসিমুখে একে অপরের সাথে মিলিত হয়। সবাই সাম্যবাদের মর্মকথা হরহামেশা উচ্চারণ করলেও ঈদুল আজহা বা কোরবানির দিন তার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠে।

 

কোরআন-হাদিসের অসংখ্য জায়গায় কোরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে পাকের সবচেয়ে ছোট সূরা, সূরায়ে আল কাওছারে ফরমায়েছেন, “অতএব তুমি তোমার প্রভুর উদ্দেশ্যে নামাজ পড় এবং কোরবানি কর।”

 

কোরবানি মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ছাড়া কবুল হয় না। নিবেদিত প্রাণ, গভীর আন্তরিকতা ও ইসলামী শরীয়তের প্রতি অগাধ আস্থা সহকারে কোরবানি পেশ করতে হবে।

 

পৃথিবীতে ধর্মকর্মের ইতিহাস যত প্রাচীন কোরবানির ইতিহাসও তেমনি যুগ যুগান্তরে চলে আসছে। মানবজাতির জন্য আল্লাহ পাকের তরফ থেকে যত শরীয়ত নাযিল হয়েছে প্রত্যেক শরীয়তে কোরবানির হকুম বিদ্যমান ছিল। সকল উম্মতের এ ছিল ইবাদতের এক অমোঘ বিধান। আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন, “আর আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক রীতিনীতি নির্ধারণ করেছি যেন তারা ঐ সব পশুর উপর আল্লাহ পাকের নাম নিতে পারে যে সব তিনি তাদেরকে দান করেছেন। ” (সূরা আল হজ্জ-৩৪)

 

কোরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানা যায়, আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এর সন্তান হাবিল ও কাবিল প্রথম কোরবানি পেশ করেন। তখনকার সময় প্রতি গর্ভ থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান যমজ হিসেবে জন্মগ্রহণ করত এবং তারা পরস্পরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারতো না। দেখা গেছে, হাবিলের সহোদর হিসেবে যে বোনটি ভূমিষ্ট লাভ করেছে সে কাল ও বিশ্রী আর কাবিলের সহোদর বোন হলো খুবই রুপসী ও মায়াবতী। শরীয়তের বিধান অনুসারে কাবিলকে হাবিলের সহজাত বোন আর হাবিলকে কাবিলের সহজাত বোন বিবাহ করতে হবে। এতে কাবিল রাজি না হওয়ায় বিবাদের সৃষ্টি হয়। অতঃপর উভয়ের পিতা হযরত আদম (আ.) হাবিল ও কাবিলের মতভেদ দূর করার জন্য বললেন, ‘তোমরা উভয়ে সামর্থানুযায়ী আল্লাহ তা‘য়ালার উদ্দেশ্যে কোরবানি পেশ কর, যার কোরবানি কবুল হবে সে কাবিলের সহজাত বোন রূপ লাবণ্যে অনন্যা আকলিমাকে বিয়ে করতে পারবে’।

 

এ ঘটনার সত্যায়নে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন “আর তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের ঘটনা শুনিয়ে দাও, যখন তারা দুইজনেই কোরবানি পেশ করলো, তখন তাদের একজনের কোরবানি কবুল হলো অপরজনের কোরবানি কবুল হলো না। (সূরা আল মায়েদা – ২৭)

 

আল কুরআনে হযরত ইবরাহীম (আ.) কে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হিসেবে ভূষিত করা হয়েছে আর কোরবানি তারই অন্যতম সুন্নাত, আদর্শ। বর্তমানে আমাদের সমাজে যে কোরবানি প্রথা চালু আছে তার সাথে যে ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত রয়েছে তা আল কোরআনের সূরা আস সাফফাতের ১০২-১১২ আয়াতে কারীমায় সুন্দরভাবে বিবৃত হয়েছে- “যখন সে (ইসমাঈল আ.) তার সাথে চলাফেরার বয়সে পৌঁছলো তখন একদিন ইব্রাহীম (আ.) তাকে বললোঃ প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে তোমাকে যেন জবেহ করছি। বল দেখি কি করা যায়? পুত্র বিনা দ্বিধায় বললো, আব্বা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা শীঘ্রই পালন করুন। ইনশাল্লাহ, আপনি আমাকে অবিচল দেখতে পাবেন। অবশেষে পিতাপুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদের সোপর্দ করলেন এবং ইবরাহীম (আ.) পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন (জবেহ করার জন্য) তখন আমরা তাকে আহ্বান করে বললাম, ইবরাহীম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমরা সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত: এ এক সুস্পষ্ট অগ্নিপরীক্ষা। আর আমরা বিরাট কোরবানি ফিদয়া স্বরূপ দিয়ে তাকে (ইসমাঈল আ.) উদ্ধার করেছি। আমরা ভবিষ্যতের উম্মতের জন্য ইবরাহীমের এ সুন্নাতকে স্মরণীয় করে রাখলাম। ইবরাহীম (আ.) এর উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এভাবে জীবনদানকারীদেরকে আমরা এ ধরনের প্রতিদানই দিয়ে থাকি। নিশ্চিত রূপে সে মুমিন বান্দাদের মধ্যে শামিল”।

 

তাফসীরে এসেছে, হযরত ইবরাহীম (আ.) তদীয় পুত্র ইসমাঈল (আ.) কে জবেহ করতে বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ মনোরথ হলে ছুরি হাত থেকে ফেলে দেন। এমতাবস্থায় হযরত জিবরাঈল (আ.) ঐশী প্রত্যাদেশে হযরত ইসমাঈল (আ.) এর বদলে কোরবানির জন্য একটি দুম্বা নিয়ে হাজির হন এবং ইবরাহীম (আ.) ঐ দুম্বা আল্লাহর নামে কোরবানি দেন। সেই পবিত্র স্মৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ হাজি সাহেবান মক্কাতুল মুকাররমার মিনা প্রান্তরে এবং সারা দুনিয়ায় কোটি কোটি মুসলমান নিজ নিজ এলাকায় গৃহপালিত পশু কোরবানি প্রদান করেন আর এভাবেই মুসলিম উম্মাহর কাছে কোরবানি প্রথা অদ্যাবধি চলে এসেছে। এ কোরবানির মধ্য দিয়ে মুসলিমরা তাদের মনের পশুত্বকে বিসর্জন দেন এবং আল্লাহর আদেশের প্রতি ত্যাগ-নিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। যারা কোরবানিকে অযথা পশু হত্যার যুক্তি দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে তাদের প্রতিবাদে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর লিখা ‘কোরবানি’ নামক কবিতার শেষ চরণ উল্লেখ করে সমাপ্ত করছি…

“ ঐ খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ,

আজ আল্লাহর নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদবোধন। ”

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট