চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

আল্লাহপাকের নৈকট্য লাভই কোরবানির উদ্দেশ্য

নাসির উদ্দিন

২৩ জুন, ২০২৩ | ১:৪৯ অপরাহ্ণ

সামর্থ্যবান পুরুষ-মহিলার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। এটি ইসলামের মৌলিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আদম (আ.) থেকে শুরু করে সব নবীর যুগেই কোরবানি পালিত হয়েছে। কোরবানি শব্দের আভিধানিক অর্থ নৈকট্য লাভ করা। তাই প্রতিবছর বিশ্বের সামর্থ্যবান মুসলমানগণ আল্লাহপাকের নৈকট্য লাভের জন্য কোরবানি আদায় করেন। এছাড়া গরিব-দুঃখী ও পাড়া-প্রতিবেশীর আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়। আল্লাহ ও তার রাসূলের শর্তহীন আনুগত্য, ত্যাগ ও বিসর্জনের শিক্ষাও আছে কোরবানিতে।
যারা কোরবানি করবেন তাদের জন্য রাসূল (সা) একটি বিশেষ সুন্নত এর কথা বলেছেন। যারা কোরবানি করতে ইচ্ছুক তারা যেন জিলহজ মাসের চাঁদ উদয় হওয়ার পর থেকে কোরবানি করা পর্যন্ত কোন ধরণের পশম, নখ, ইত্যাদি না কাটে। যদি না কাটে তাদের আরেকটি কোরবানির সওয়াব দেয়া হবে। ঠিক তেমনি যারা কোরবানির সামর্থ্যবান নয়, তারাও যদি জিলহজ মাসের ১-১০ তারিখ কোরবান সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নিজের শরীরের পশম, নখ পরিষ্কার না করে তাদেরও আল্লাহপাক সেই সওয়াব দেবেন।
তাই আমরা শরীরের পশম, নখ আগে- পরে কাটবো যাতে সুন্নতটি আদায় হয়। দাঁড়ি রাখা ‍ওয়াজিব। এক মুস্টি রাখা সুন্নতে মোয়াক্কাদা। দাঁড়ি মুন্ডানো কবিরা গুনাহ। সুন্নতে মোয়াক্কাদা বার বার লংঘন করলে কবিরা গুনাহে পরিণত হয়। ওয়াজিব বর্জন করলে কবিরা গুনাহ। সুন্নত বর্জন করলে সগীরা গুনাহ। কবীরা গুনাহের পর তওবা করলে বিলুপ্ত হয়ে যায়। সগিরা গুনাহ বার বার করলে সেটি কবিরা হয়ে যায়। হযরত ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণিত হাদীস: এক মুষ্টি থেকে দাঁড়ি ছোট করা ইসলামে নেই। রাসূল (সা) বলেছেন, তোমরা দাঁড়ি লম্বা কর, গোঁফ ছোট কর। গোঁফ ছোট করা সুন্নত। মানুষের বোগল, নাক ও লজ্জাস্থানের লোম পরিষ্কার করা ও সুন্নত। মানুষের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য আল্লাহপাক অনেক কিছু দিয়েছেন। পুরুষের জন্য দাঁড়ি আর নারীর জন্য দিয়েছেন মাথায় লম্বা চুল। নারীর মাথার চুল মুন্ডানো নাজায়েজ। চুল কাটতে পারবে, তবে পুরুষের সাদৃশ্য হতে পারবে না। অনেক মহিলার মাঝে মধ্যে দেখা যায় দাঁড়ি বা গোঁফ উঠে। সেগুলো তারা পরিষ্কার করতে পারবেন। এভাবে মানুষ পরিষ্কার থাকাটা রাসূল (সা) সুন্নাত করে দিয়েছেন।
হাদীসের মধ্যে রয়েছে-প্রতি সপ্তাহে জুমার দিন নখ ও অবাঞ্চিত লোম পরিষ্কার কর। এক সপ্তাহে না পারলে দুই সপ্তাহে, তা না পারলে তিন সপ্তাহে পরিষ্কার কর। তাও না পারলে ৪০দিনের মধ্যে একবার পরিষ্কার কর। কিন্তু কেউ যদি যেসব কাটা প্রয়োজন সেগুলো না কেটে রেখে দেয় মাকরুহ, গুনাহ হবে। অনেকে ওযরের কারনে সর্বোচ্চ ৪০দিন পর্যন্ত দেরী করতে পারবেন। মৃত ব্যাক্তির কোন ধরণের কর্তন শরিয়তে নাজায়েজ। কারণ তার নখ, লোম ৪০দিনের বেশি থাকলেও কাটতে পারবেন না। গুনাহ হবে। বরং আপনার যদি ভাল নিয়ত থাকে মুমূর্ষ অবস্থায় কেটে দিন। মারা যাওয়ার আগে কেটে দিবেন। মুমূর্ষ অবস্থায় লজ্জাস্থানও পরিষ্কার করা যায়, মহররম দিয়ে । জীবিত থাকতে আপনার দায়িত্ব। মৃত্যুর পর আপনার দায়িত্ব নয়। যা করবেন মৃত্যুর আগে করবেন। পরে কোন কিছু করার সুযোগ নেই। মৃত্যুর আগে করলে সওয়াব পাবেন। মৃত্যুর পর কাটলে গুনাহ হবে। কাটা নখ, চুল যাতে পদদলিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
আল্লাহপাক জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের মধ্যে নখ, চুল না কাটাকে রাসূল (সা) এর মাধ্যমে সুন্নত করে দিয়েছেন। পবিত্র আল কোরআনের সূরা ফজরে আল্লাহপাক বলেছেন, ফজরে’র কসম। মোহাদ্দিস ও মোফাস্সিরে কেরাম ফজরে বলতে বুঝিয়েছেন জিলহজ মাসের কোরবানির দিনের ফজর। কারণ সেই দিনের মধ্যে আল্লাহপাক আমাদের জন্য বিশাল হেদায়েত রেখেছেন। প্রথমে নামাজ তারপর আর্থিক ইবাদত কোরবানি। জিলহজ মাসের ১০ তারিখকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য এই কোরবানির দিনের ফজরের শপথ করেছেন। আল্লাহপাক কোন কিছুর শপথ গ্রহণ করার অর্থ হলো তাঁকে সম্মান দেওয়া। কোরবানির দিনের ফজরের কসম আরো শপথ করেছেন জিলহজ মাসের প্রথম দশ (১-১০) রাতের কসম। এই ১০ রাতের শপথ আল্লাহপাক এজন্য করেছেন জিলহজ মাসের প্রত্যেকটি রাতের মর্যাদা বেশি।
হাদীসের মধ্যে আছে: মুহাম্মদ (সা) বলেছেন, জিলহজ মাসের প্রথম (১-৯) তারিখ পর্যন্ত যারা রোজা রাখবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এক বছর নফল রোজার সওয়াব দেবেন। ৯টি রোজা রাখা মাস্তাহাব ঈদের আগের দিন পর্যন্ত। আবার ঈদের রাতসহ ১০টি রাত মর্যাদাবান। এছাড়া ৯তারিখ আরাফা এর রোজায় এক বছর নফল ইবাদেতের পাশাপাশি অতিরিক্ত আরো দুটি মর্যাদা রয়েছে। মুহাম্মদ (সা) বলেছেন, আরাফা এর দিন ৯ তারিখে যিনি রোজা রাখবেন আল্লাহপাক এক বছর নফল ইবাদতের সওয়াব দিবেন সাথে সাথে তার বিগত একবছর এবং সামনের এক বছরের গুনাহ এর কাফ্ফারা করে দিবেন।
আরাফা দিন এর রোজায় বিগত এবং সামনের দুই বছরের গুনাহ এর কাফ্ফারা হয়ে যায়। আল্লাহপাক এভাবে মর্যাদা দিয়েছেন আরাফা দিনের রোজাকে। বিশেষ করে আরাফা দিনের রোজাকে আমরা গুরুত্ব দেব। তাই অনেকে বলেন, যাদের আরাফা দিনের রোজা রাখার তৌফিকে হবে তারা আগামী এক বছর জীবিত থাকবেন। কেন? রাসূল (সা) যেমনি বলেছেন, তার সামনের এক বছরের ‍গুনাহর কাফ্ফারা হয়ে যাবে। সামনের একবছর যদি তিনি জীবিত না থাকেন তাহলে কাফ্ফরা কিসের হবে। এটি অনেকে গবেষণা করে সম্ভাব্য ফালাফল বর্ণনা করেছেন। এত আশা করা যায় আল্লাহপাক তাকে আরো এক বছর হায়াত দেবেন। সে কারনে অত্যন্ত দামী রোজা।
সামর্থ্যবান পুরুষ মহিলার ওপর কোরবানি ওয়াজিব।যারা জাকাত পেতে পারেন না, যারা সদকায়ে ফিতর আদায় করেন। আপনার মাসিক খরচ, ঋণ বাদ দিয়ে সাড়ে ৫২ তোলা রূপার দাম সমান নগদ টাকা বা ব্যবসার সম্পদ থাকলে তখন আপনার উপর কোরবানি ওয়াজিব। আপনার মাসিক খরচ ও দেনা বাদ দিয়ে ৮২ হাজার নগদ টাকা থাকলেও কোরবানি দিতে হবে। চাষের জমির জন্য কোরবানি ওয়াজিব হবে না। যৌথ পরিবারে একবছর একজনের নামে কোরবানি দেয়া জায়েজ নয়। বরং যার সম্পদ আছে তার নামে কোরবানি হবে। কারণ তার উপর ওয়াজিব। কোরাবনি দেওয়ার সময় যার নামে কোরবানি হবে তার অনুমতি লাগবে। অনুমতি ছাড়া তার নামে কোরবানি দিলে তা নফল কোরাবনি হবে। আপনার কোরাবনি পৃথিবীর যে কোন জায়গায় দিতে পারবেন। তবে আপনার নির্দেশে দিতে হবে। তবে আপনার নির্দেশ না থাকলে নফল কোরাবনি হবে, ওয়াজিব হবে না।
বিশেষ কারনে কোরবানি না দিতে পারলে তার উচিত হবে কোরবানির টাকাগুলো গরীবদের মাঝে দান করা। কেরাবনির সুযোগ থাকা সত্বেও তা না করে দান করলে গুনাহ হবে। বরং আপাকে সর্বাত্নক চেষ্টা করতে হবে কোরবানিব আদায়ের জন্য। নিষ্ফল হলে দামটা সদকা করতে পারবেন। সবচেয়ে উত্তম হলো গৃহপালিত পশু দিয়ে কোরাবনি করা। কারণ: ইব্রাহিম (আ)কে আল্লাহপাক স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন, তোমার প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি কর। সুতরাং প্রিয় বস্তু। আল্লাহপাকের পরীক্ষায় পাশ হওয়াতে. তাঁর দৃঢ়তা দেখে সেটা স্থগিত করেছিলেন। সুতরাং প্রিয় প্রাণীকে কোরাবনি দিতে হবে। আপনার পছন্দে কোরবানি দিবেন। গোশত যাতে উদ্দেশ্য না হয়। উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর জন্য কোরবানি। মানুষকে দেখানোর জন্য নয়। ঋণ করে কোরাবনির প্রয়োজন নেই।
নবীজিকে আল্লাহতাআলা নির্দেশ দিয়েছেন- আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি আদায় করুন।(সুরা কাওসার:২)
অন্য আয়াতে এসেছে- (হে রাসূল!) আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ রাব্বুল আলামীনের জন্য উৎসর্গিত। (সুরা আনআম : ১৬২)
জীবনঘনিষ্ঠ ধর্ম ইসলামে সকল বিধানের স্বরূপ, আদায়ের পদ্ধতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। তাই কোরবানি আদায়ের সকল বিধানও আমরা পেয়ে যাই কোরআন ও হাদিসের বর্ণনায়।
কোরবানির পশুগুলোর ক্ষেত্রে উটের বয়স অন্তত পাঁচ বছর হতে হবে। আর গরু ও মহিষের হতে হবে দুই বছর। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার হতে হবে এক বছর। ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে তা ছয় মাসের হলেও চলবে। তবে তা বিশেষ কারণে কিংবা ভেড়া ও দুম্বা দেখতে এক বছর বয়সীর মতো দেখালে।
আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে প্রবেশ করলেন। অথচ মক্কা প্রবেশ করার পূর্বেই সারিফ নামক স্থানে তার মাসিক শুরু হল। তখন তিনি কাঁদতে লাগলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমার কি হয়েছে? মাসিক শুরু হয়েছে না কি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ এটা তো এমন এক বিষয় যা আল্লাহ আদম (আলাইহিস সালাম) এর কন্যা সন্তানের উপর নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং তুমি আদায় করে যাও, হাজীগণ যা করে থাকে, তুমিও অনুরুপ করে যাও। তবে তুমি বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করবে না। এরপর আমরা যখন মিনায় ছিলাম, তখন আমার কাছে গরুর গোশত নিয়ে আসা হল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এটা কি? লোকজন উত্তর করলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রীদের পক্ষ থেকে গরু কুরবানী করেছেন।
আল্লাহপাক আমরা জিলহজ মাসের আমল এবং কোরাবনি যাতে সঠিক নিয়মে পালন করতে পারি, সে তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন চট্টগ্রাম

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট